লকডাউনে বেসামাল, বন্ধ হল স্বাধীন ভারতের প্রথম সাইকেল প্রস্তুতকারক সংস্থা অ্যাটলাস

সত্তর বছর ধরে পথ চলেছে সে। ঝড়-জল, খানা-খন্দ পেরিয়ে এসেছে অনায়াসেই। তবে লকডাউনের এই বড়োসড়ো আর্থিক মন্দা আর সামাল দেওয়া গেল না। থেমে গেল দু’চাকার ঘূর্ণন। অ্যাটলাস। স্বাধীন ভারতের প্রথম এই সাইকেল প্রস্তুতকারক সংস্থা বন্ধ করল তাঁদের শেষ কারখানাটি। কাজ হারালেন প্রায় ৭০০ জন কর্মী।

১৯৫১ সাল। বছর চারেক আগেই স্বাধীন হয়েছে ভারত। একটু একটু করে গুছিয়ে ওঠছে দেশ। আমদানির উপর নির্ভরতা ঝেড়ে ফেলে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন কারখানা। শ্রী জানকী দাস কপুর প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন কয়েক বছর আগেই। ভারতের বাজারে দেশীয় বাইসাইকেল আনার লক্ষ্যেই সোনেপথে ২৫ একর জায়গা জুড়ে তৈরি করছিলেন কারখানা। ১৯৫১ সালে উদ্বোধন হল সে কারখানা। সেই সঙ্গে কর্মসংস্থান হল অনেক মানুষের। সেই সঙ্গে দেশের মানুষ পেল সুলভে ব্যক্তিগত দু’চাকার বাহন। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল গ্রিক দেবতার নাম। অ্যাটলাস।

শুরুতে বাজার আয়ত্ত করা খুব একটা সহজ ছিল না অ্যাটলাসের পক্ষে। কারণ ওই একই বছরে ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আরো একটি সাইকেল প্রস্তুতকারক সংস্থা। অ্যাভন। কিন্তু প্রথম বছরে, অ্যাটলাসে তৈরি হওয়া ১২০০০টি সাইকেলের একটিকেও পড়ে থাকতে হয়নি গুদামে। কম দাম এবং মজবুতির জন্যই অন্যান্য দেশি-বিদেশি কোম্পানির ঊর্ধ্বে প্রথম পছন্দ হিসাবে অনেকেই বেছে নিয়েছিলেন অ্যাটলাসকে। 

তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি এই সংস্থাকে। বরং আমদানি-রপ্তানির খেলাটা উলটে গেল একেবারে। ১৯৫৮ সালে বিদেশে পাড়ি দিল অ্যাটলাসের তৈরি সাইকেল। ইতালি, ফ্রান্সের মতো একাধিক দেশের বাজারেও জায়গা করে নিল অ্যাটলাস। ১৯৬৫ সালে ভারতের সব থেকে বড় সাইকেল প্রস্তুতকারক কারখানা হিসাবে উঠে আসে অ্যাটলাসের নাম। তারপর থেকে প্রায় এককভাবেই বাজারে রাজত্ব করে সংস্থাটি। ইতালির গোল্ড মার্কারি ইন্টারনেশনাল অ্যাওয়ার্ড জুড়ে যায় অ্যাটলাসের নামের পিছনে। ঝুলিতে আসে এফআইসিসিআই পুরস্কারও। একে একে বাড়তে থাকে কারখানা এবং বিপণীর সংখ্যা। এক বছরে সর্বোচ্চ ৪০ লক্ষ সাইকেলও একসময় প্রস্তুত করেছে অ্যটলাস। দেশে নানান প্রান্তে ১৪টি রাজ্যজুড়ে ছিল তাদের ৬০০টি নিজস্ব বিপণী। 

আরও পড়ুন
সাইকেলের ব্যবহার বাড়লে ভালো থাকবে কলকাতাও

১৯৭৮ সালে নতুন চমক এনেছিল অ্যাটলাস। রেসিং সাইকেল। পাশাপাশি ভিন্ন বয়স এবং ভিন্ন নকশার প্রকার নিয়ে আসে অ্যাটলাস। ১৯৮২-র নবম এশিয়াড গেমসে দিল্লিতে ব্যবহৃত হয়েছিল কেবলমাত্র অ্যাটলাসের সাইকেলই। সাইকেলের চাহিদা এবং সরবরাহ সামাল দিতেই গুরগাঁওতে খুলতে হয়েছিল স্টিল-রড প্রস্তুতির কারখানা।

আরও পড়ুন
গাড়ি অমিল, সাইকেলে চেপেই কলকাতায় আসছেন ভিন জেলার মানুষরা

শুধু মাত্র পণ্যে নয়, বিজ্ঞাপনেও অভিনবত্ব এনেছিল অ্যাটলাস। “সুন্দরতা মে পল পল রুচি রাখনে ওয়ালে লোগ অ্যাটলাস চাহাতে হ্যায়!” অনন্য এই বিজ্ঞাপনের লাইন নজর কেড়েছিল। সেই সঙ্গে অ্যাটলাসের বিজ্ঞাপনে বারবার উঠে এসেছিল মহিলা ক্ষমতায়ন। লিঙ্গ বৈষম্যতার দৃষ্টিভঙ্গিকেও পাল্টে দিয়েছিল তাদের তারিখা। বিজ্ঞাপনে সাইকেল চালাতে দেখা যেত পাশাপাশি একটি ছেলে ও মেয়েকে। দেখা যেত সাইকেল নিয়ে কর্মক্ষেত্রে যাওয়া মহিলাকে হাত নেড়ে খুশি মুখে বিদায় জানাচ্ছে তার স্বামী। সমাজের উদ্দেশ্যে এমনই শক্তিশালী বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল অ্যাটলাস। একসময় ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডার ছিলেন সানিয়া মির্জা।

আরও পড়ুন
মাথায় ফুটবল, সাইকেলে নেই হাত, ব্যালেন্সে বাজিমাত কলকাতার সরোজের

তবে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়েই খানিকটা হোঁচট খেল ঐতিহ্যবাহী এই কারখানা। একুশ শতকের শুরুর দিক থেকেই ধীরে ধীরে কমতে থাকে সাইকেলের চাহিদা। মোটর সাইকেলের দিকে ঝুঁকতে থাকে নতুন প্রজন্ম। সেই সঙ্গে সাইকেলের জগতেও কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ায় বিএসএ, হিরো, হারকিউলিসের মতো কোম্পানিরা। ২০১২ থেকে এক এক করেই বন্ধ হতে থাকে অ্যাটলাসের কারখানাগুলি। ২০১৪ সালে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মধ্যপ্রদেশের মালানপুর কারখানা। ২০১৮তে সোনেপথের প্রথম কারখানাটিও বন্ধ করে সদর দরজা। অ্যাটলাসের একমাত্র প্রস্তুতকারী কেন্দ্র হিসাবে ধুঁকছিল শাহিদাবাদ। এবার বন্ধ হয়ে গেল সেটিও।

আরও পড়ুন
নদী বাঁচাতে চাকরি ছেড়ে সাইকেলে ভারতভ্রমণ বঙ্গসন্তানের

আশ্চর্যের ব্যাপার, যে মুহূর্তে সারা দেশ সাইকেলের দিকে ঝুঁকছে, ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে বাস-অটো ছেড়ে ফিরে যাচ্ছে সাদা-কালোর দিনগুলোয়। তখনই দু’চাকার এক ঐতিহ্যবাহী সংস্থাকে হার মেনে নিতে হচ্ছে পরিস্থিতি আর মন্দার কাছে। তাও আবার ‘বিশ্ব সাইকেল দিবস’-এর দিনই মৃত্যু হল অ্যাটলাসের। গত ৩ জুন কারখানার গেটে নোটিস টাঙিয়েই অনির্দিষ্টকালের জন্য থমকে গেল অ্যাটলাস। স্বীকার করে নিল ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি এবং নিঃস্বতার কথা। তবে আগে থেকে কি জানানো যেত না কর্মীদের? আকস্মিক নোটিসে বেকারত্বের ছায়া নেমে এসেছে ৭০০-র বেশি পরিবারে। যে কারখানা একসময় কাজ জুগিয়েছিল বেকারদের, পরিস্থিতির চাপে তাকেই ভিলেন হতে হল শেষ অবধি। এ যেন এক আশ্চর্য ট্র্যাজেডি।

আরও পড়ুন
সাইকেলে কলকাতা থেকে ডুয়ার্স, পথজুড়ে চারাগাছ রোপণ অভিযাত্রীদের

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
গোটা সাইকেলটাই পাটের তৈরি, চমক বাঙালি ইঞ্জিনিয়ারের

More From Author See More