পূর্বভারতে একের পর এক ভ্যাকসিনের ট্রায়াল, নেপথ্যে বাঙালি গবেষকরা

“কোভিডে কার্যকারী ওষুধ বা ভ্যাকসিনগুলোর সুবিধা যাতে বাংলার মানুষ প্রথমেই পায়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য। প্রথমদিকে দেশের অন্যান্য অংশের থেকে এই জায়গাটায় বাংলা খানিকটা পিছিয়ে ছিল।”

বলছিলেন পিয়ারলেস হাসপাতালের ক্লিনিকাল ডায়রেক্টর অফ ক্লিনিকাল রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাকাডেমি ডঃ শুভ্রজ্যোতি ভৌমিক। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি অফ মেডিসিনে ক্লিনিকাল ট্রায়াল নিয়ে তিনি কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। ছিলেন অর্থোপেডিক বিভাগের সিনিয়র ক্লিনিকাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট। প্রথম ভারতীয় চিকিৎসক হিসাবে পেয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রোগী নিরাপত্তা সম্মান। এবার ডঃ ভৌমিক এবং তাঁর টিমের হাত ধরেই ভারতের মানচিত্রে উঠে আসছে বাংলার নাম। কারণ, গোটা পূর্ব ভারতের মধ্যে ভ্যাকসিন এবং কোভিডের কার্যকারী ওষুধের ক্লিনিকাল ট্রায়ালের অন্যতম কেন্দ্রই এখন পশ্চিমবঙ্গ।

কোভিশিল্ড ও কোভ্যাকসিনের পর তৃতীয় ভ্যাকসিন হিসাবে ভারত বেছে নিয়েছিল রাশিয়ান ভ্যাকসিন স্পুটনিককে। ডিজিসিআইয়ের ছাড়পত্র পেয়ে যা চলেও এসেছে ভারতীয় বাজারে। সেই স্পুটনিকের ট্রায়াল হয়েছিল কলকাতাতেই। পূর্ব ভারতের মধ্যে একমাত্র ট্রায়ালকেন্দ্র ছিল পিয়ারলেস হাসপাতাল। 

তবে শুধুই কি স্পুটনিক? “আহমেদাবাদে তৈরি জাইকোভ ডি-এর ট্র্যায়াল হয়েছে কলকাতায়। আমরা ১২০০ মানুষের উপর প্রয়োগ করেছি এই টিকাটি। খুব তাড়াতাড়িই শুরু হবে জনসন অ্যান্ড জনসনের সিঙ্গেল শট ভ্যাকসিনের ট্র্যায়াল। তাছাড়া ভারতীয় স্পুটনিক বনাম রাশিয়ান স্পুটনিকের একটা কম্প্যারিজন স্টাডিও করব আমরা। সেটার সেকেন্ড ট্রায়ালও শুরু হবে কিছুদিনের মধ্যেই”, জানালেন ডঃ ভৌমিকের সহযোদ্ধা স্নেহেন্দু কোনার। রাজ্যের ভ্যাকসিন ট্রায়ালের ফেসিলিটেটর তিনি। 

বর্তমানে ভারতে কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গের গ্রাফ ক্রমশ নিম্নমুখী। কিন্তু এর মধ্যেই আশঙ্কা বাড়ছে তৃতীয় তরঙ্গের। আর গবেষণা বলছে সেখানে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবথেকে বেশি শিশুদের মধ্যে। তবে তৃতীয় তরঙ্গ আঘাত হানার বহু আগে থেকেই যে লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে বাংলা, তা পরিষ্কার। স্নেহেন্দুবাবু জানালেন, জাইকোভ-ডি ভ্যাকসিনটির ক্লিনিকাল ট্রায়াল হয়েছে ১২-১৭ বছরের শিশুদের মধ্যেও। কলকাতার মোট ছ’টি কেন্দ্রে তাঁরা এই ট্রায়ালটি করেছেন সম্প্রতি। 

সেইসঙ্গেই চলছে কোভিডে জীবনদায়ী একাধিক ওষুধের ট্রায়ালও। ডিআরডিও-র তৈরি ২-ডিজি ওষুধই হোক কিংবা কোভিডে ভেরাফিনের পুনর্ব্যবহার— সবটারই ট্রায়াল হয়েছে বাংলায়। উল্লেখ্য, এই দুটি ওষুধই আশ্চর্যজনকভাবেই অক্সিজেনের চাহিদা কমাতে সক্ষম। এবং মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই রোগীর কোভিড রিপোর্ট নেগেটিভ করে দিতে সক্ষম ওষুধ দুটি।  

কিন্তু শুনতে খুব সহজ মনে হলেও, ক্লিনিকাল ট্রায়ালের গোটা প্রক্রিয়াটা বেশ জটিল। “একটা ক্লিনিকাল ট্রায়াল করতে গেলে প্রথমে এথিক্স কমিটির অনুমতি লাগে। সেখানে চিকিৎসকরা ছাড়াও সাধারণ মানুষ, শিক্ষক, আইনজীবী-সহ বহু মানুষ থাকেন। তাঁদের অনুমতি নিয়ে তারপরই শুরু হয় ট্রায়াল”, বলছিলেন শুভ্রজ্যোতিবাবু। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আরও একটা বড়ো বাধা হল স্বেচ্ছাসেবকদের রিক্রুটমেন্ট। পিয়ারলেস হাসপাতালের ক্লিনিকাল রিসার্চ কোঅর্ডিনেটর ডঃ দেবারতি কুণ্ডু জানালেন, “ট্রায়ালের আগে প্রতি স্বেচ্ছাসেবকদের পুরো বিষয়টি বিস্তারিত জানানো হয়। তারপর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে, তাঁদের অভিমত নিয়েই শুরু হয় ট্রায়াল। এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয় স্বেচ্ছাসেবকদের পরিচয়ও।”

আর বিপদের ঝুঁকি? “অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে এসে তারপর এই ট্রায়ালটা হয়। নিশ্চয়ই কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। তবে ব্যাপারটা একেবারেই গিনিপিগের দেহে ওষুধ প্রয়োগের মতো নয়”, ডঃ দেবারতি কুণ্ডু ব্যাখ্যা করলেন বিষয়টি। তাছাড়াও ক্লিনিকাল ট্রায়ালে সাবজেক্ট বা স্বেচ্ছাসেবকদের কোনোরকম শারীরিক সমস্যা হলে, তার সম্পূর্ণ দায়িত্বও নেয় সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল। চিকিৎসার খরচ এবং ক্ষতিপূরণের দায়ভার নেয়, সংশ্লিষ্ট ওষুধ নির্মাণ সংস্থাটি, সেটাও জানালেন তিনি। 

কিন্তু তা সত্ত্বেও কতজন মানুষ এগিয়ে আসছেন ট্রায়ালে? কলকাতারই এক স্বেচ্ছাসেবক ঋষভ মুখোপাধ্যায় সেই আবেদনই রাখছেন সাধারণের কাছে। তাঁর কথায়, “অনেকেই বিষয়টাতে ভয় পান, খারাপের আশঙ্কা করেন। কিন্তু এটা বুঝতে হবে, যে নিজেদের স্বার্থেই আমাদের অংশ নিতে হবে ট্রায়ালগুলিতে। এই ভ্যাকসিনটা না এলে ভবিষ্যতে অনেকটাই ক্ষতি হয়ে যাবে গোটা মানবজাতির। অনেকেই ভাবছেন ট্রায়ালে ভ্যাকসিন পেয়ে মানুষ যদি মারা যায়। বিষয়টা একেবারেই তেমন না। ভ্যাকসিন ট্রায়ালের পরও চিকিৎসকরা প্রতিনিয়তই আমাদের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ চালিয়ে গেছেন।”

কিন্তু আজ থেকে বছর দশেক আগের কথাও যদি বিবেচনা করা যায়, তাহলে দেখা যাবে এই ধরনের কোনো গবেষণাই সেইভাবে হত না বাংলায়। বাংলা তো বটেই, এমনকি বর্তমানেও ক্লিনিকাল ট্রায়ালের দিক থেকে যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে পূর্বভারত। গোটা ভারতে যেখানে কোনো ওষুধ কিংবা ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের জন্য ৫০টি সাইট বেছে নেয় ভারত সরকার, সেখানে রেগুলেটরি কারণে মাত্র ৩টি বা ৪টি সাইট রাখা হয় পূর্ব ভারতে। সেই জায়গাটাকেই আরও মজবুত করার চেষ্টা করে চলেছেন ডঃ ভৌমিক এবং তাঁর সহযোদ্ধারা। 

স্নেহেন্দুবাবু জানালেন, “ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফর ক্লিনিকাল রিসার্চ বলে যে জাতীয় সংস্থাটি রয়েছে, তার ইস্টার্ন চ্যাপ্টার ছিল শূন্য। সেই জায়গাটাতে বিকাশের চেষ্টা করে চলেছি আমরা।” বর্তমানে এই সংস্থার চেয়ারম্যান পদে রয়েছে ডঃ ভৌমিক। স্নেহেন্দুবাবুও এই সংস্থার অন্যতম একজন সদস্য। তবে চিকিৎসকরা এই গবেষণায় এগিয়ে না এলে, এই শূন্যস্থান পূরণ করা প্রায় অসম্ভব। আর সেজন্যেই চিকিৎসাবিদ্যার শিক্ষার্থীরা যাতে পাঠক্রমেই এই গবেষণার সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠতে পারে, সেটাই লক্ষ্য ডঃ শুভ্রজ্যোতি ভৌমিকের। তাঁর পাখির চোখ, প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজেই এই গবেষণার পরিকাঠামো তৈরি করা। সেই সুদিন আসতে খুব বেশি দেরি নেই আর…

Powered by Froala Editor