১০ টাকার পরিবর্তে বলুন নিজের সমস্যার কথা, অবসাদের বিরুদ্ধে লড়াই পুনের ছাত্রের

পুনের ফার্গুসন কলেজ রোড। এই রাস্তা ধরেই সন্ধেবেলা হাঁটতে থাকলে দেখা মিলবে তাঁর। মুখে মাস্ক, পিঠে ব্যাগ আর হাতে ধরে থাকা ছোট্ট প্ল্যাকার্ড। তাতে লেখা ‘টেল মি ইয়োর স্টোরি ইয়োর স্টোর এন্ড আই উইল গিভ ইউ রুপিস ১০’। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে যত বেড়ে চলেছে এগিয়ে যাওয়ার ইঁদুর দৌড়, ততই যেন বাড়ছে সংকীর্ণতা, একাকিত্ব। আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে মানুষ। ফলে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অবসাদও। এই একাকিত্ব থেকে খানিকটা মুক্তির সন্ধান দিতেই এমন উদ্যোগ নিয়েছেন পুনের তরুণ।

রাজ বিনায়ক ডাগওয়ার। পুনে ইনস্টিটিউট অফ কম্পিউটার টেকনোলজি’র চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রাজ। তবে পড়াশোনার চাপ সামলেই প্ল্যাকার্ড হাতে মানুষের গল্প, সমস্যার কথা শুনতেই রাস্তায় নামেন তিনি। প্রতি সন্ধেতেই। উদ্দেশ্য একটাই, না বলা কথা বলতে পেরে যেন খানিকটা হলেও হালকা হতে পারে মানুষ। জমিয়ে রাখা যন্ত্রণাদের প্রকাশ করে, খানিকটা হলেও অবসাদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে যেন।

“এমন অনেক কথা আমাদের সকলের মধ্যেই থাকে, যা ভরসা করে বলে ফেলা যায় না কাউকেই। বাবা-মা তো দূরের কথা, অনেক সময় বন্ধুদের কাছেও প্রকাশ করা যায় না সেই কথা। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেখানে উঠে আসে জাজমেন্টের প্রসঙ্গ। সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে দাঁড়িয়েও ভীষণভাবে একা সকলেই। কিন্তু অপরিচিত কারোর কাছেও যদি নিজের সমস্যাগুলো বলে ফেলা যায়, তবে অনেকটাই হালকা হওয়া যায়। সেই চিন্তাভাবনা থেকেই এই উদ্যোগ”, বলছিলেন রাজ।

আরও পড়ুন
৬০,০০০ অবসাদগ্রস্ত বৃদ্ধ-বৃদ্ধার চিকিৎসা-পরিষেবা দিল্লিতে

চলতি মাসের ৬ তারিখ থেকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে রাস্তায় নেমেছেন তিনি। দিনে প্রায় ঘণ্টা পাঁচেক সময় এভাবেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে কাটান রাজ। মাস্কের আড়ালে থেকেই শোনেন মানুষের সমস্যার কথা। কখনও কখনও সেই সংখ্যাটা পৌঁছয় দিনে প্রায় ৩০-৪০-এ। তবে প্রত্যেকের সমস্ত গল্পই সম্পূর্ণ গোপন রাখেন রাজ। প্রকাশ্যে আনেন না তাঁদের পরিচয়। শুধু তাঁদের যন্ত্রণার শরিক হয়ে রাজ ভাগ করে নেন খানিকটা দুঃখ। প্রশ্ন থেকেই যায়, এই উদ্যোগে কতটা উপকৃত হচ্ছেন পথ চলতি মানুষেরা? 

“করোনাভাইরাস মহামারী, লকডাউন আমাদের একাকিত্ব এক ধাক্কায় বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকটাই। সারাদিন ঘরের মধ্যে বন্দি থাকা দুঃসহ হয়ে উঠেছে প্রত্যেকেরই। একদিকে যেমন প্রশ্নের মুখে প্রত্যেকের কেরিয়ার, তেমনই প্রেম, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত নানান সমস্যাও রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে জমিয়ে রাখা সেইসব কথা বলতে বলতেই আবেগপ্লুত হয়ে যান অনেকে। কেউ প্রায় এক ঘণ্টা ধরে একটানা বলে গেছেন দমচাপা কষ্টদের কথা। বলতে বলতে ভেঙে পড়েছেন কান্নায়। নিজেরা হালকা হয়ে অনেকেই ধন্যবাদ জানিয়েছেন আমাকে। আমার মনে হয় বদ্ধ একটা চিন্তাভাবনা থেকে বের করে আনতে পেরে, খানিকটা হলেও সহায়তা করতে পেরেছি ওঁদের”, জানালেন রাজ।

আরও পড়ুন
কিনে আনলেন এককৌটো আফিম; কোন অবসাদে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন আলাউদ্দিন খাঁ?

একাকিত্ব যে ঠিক কতটা হতাশা, অবসাদের মধ্যে ঠেলে দিতে পারে মানুষকে— তা একদম সামনে থেকেই প্রত্যক্ষ করেছেন রাজ। বছর খানেক আগের কথা। নিজেও তিনি শিকার হয়েছিলেন এমনই দমবন্ধ পরিস্থিতির। বাবা-মায়ের কাছে নিজের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলিকে প্রকাশ করাই দায় হয়ে উঠেছিল তাঁর। মহারাষ্ট্রের নাগপুরের বাসিন্দা হলেও চাকরিসূত্রে তাঁর বাবা থাকেন দুবাইতে। তিনি নিজেও একজন ইঞ্জিনিয়ার। ফলে রাজের কেরিয়ার ঘিরেই ছিল বহু প্রত্যাশা-আকাঙ্ক্ষা। এসব কিছু চাপের মধ্যে নিজেকেই ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছিলেন রাজ। একদিকে যেমন পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব, অন্যদিকে এই মানসিক চাপে অবসাদের অতলে তলিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। সেইসময় বেশ কিছু বন্ধু-বান্ধব এবং অগ্রজরা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁরাই সাহায্য করেছিলেন এমন একটা পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে। 

আরও পড়ুন
লঞ্চ থেকে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহনন; কোন অবসাদ গ্রাস করেছিল পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে?

রাজের কথায় ইঙ্গিত পাওয়া যায়, এই ব্যস্ততার যুগে দাঁড়িয়ে কোথাও যেন অসংবেদনশীল হয়ে পড়ছি আমরা। পাশের মানুষটির সমস্যাটুকু জানতেও যেন অনীহা জন্মাচ্ছে আমাদের মধ্যে। পরোক্ষাভাবে আমরাও কি অন্যদের ঠেলে দিচ্ছি না এই একাকিত্বের দিকে? বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সেই প্রশ্ন উঠে আসতেও বাধ্য। রাজ জানালেন, “কোনো উপদেশ নয়, শুধুমাত্র একজন ভালো শ্রোতা হতে পারলেও, অন্যের মানসিক চাপ হালকা করে দেওয়া যায় অনেকটা। এমন উদ্যোগে যদি বাকিরাও এগিয়ে আসেন নিজের মতো করে, তবে সামাজিক দূরত্ব অনেকটাই কমে যাবে সকলের মধ্যে। বিচ্ছিন্নতাকে হারানো যাবে...”

একেবারেই সহজ নয় এই লড়াই। কারণ অনেকেই কাউন্সিলিং কিংবা মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসাকে অস্বাভাবিকতার চোখেই দেখতে অভ্যস্ত। রাজের এই উদ্যোগকে যেমন সাধুবাদ জানিয়েছেন অনেকে, তেমনই সমালোচনা করতেও পিছপা হননি কেউ কেউ। তবে এসবের মধ্যে পিছিয়ে আসা যায় কি? পিছিয়ে আসতেও চান না রাজ। চান সমাজের বন্ধ-মানসিকতার পরিবর্তন করতে, সেইসঙ্গে অদৃশ্য প্রাচীর ভেঙে বার করে আনতে অবসাদগ্রস্তদের। সেই লড়াইটাই একা হাতে লড়ে যাচ্ছেন তিনি। পালটে দেওয়ার এক স্বপ্ন নিয়ে...

Powered by Froala Editor

More From Author See More