পৃথিবীর অন্যতম সেরা, 'ডিলানের প্রতিদ্বন্দ্বী', কোন অবসাদে আত্মহনন ফিল ওকসের?

ষাটের দশকে উত্তাল আমেরিকায় একঝাঁক সং রাইটার উঠে এসেছিলেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত নাম বব ডিলান, সেইসময়ের কাউন্টার কালচারের আইকন। কিন্তু, সেইসময় ডিলানের সমসাময়িক আরও কিছু সংরাইটাররা ছিলেন যারা ভালো কাজ করেছিলেন। কিন্তু, ডিলানের মতন খ্যাতির শীর্ষে উঠে যেতে পারেননি। ডিলান প্রতিবাদী গান দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও, বারবার নিজেকে বদলেছেন। সেই বদলে যাওয়া মেনে নিতে পারেননি অনেকেই, যার মধ্যে পিট সিগার একজন। কিন্তু, বব ডিলানের সমসাময়িক একজন সং রাইটার ছিলেন, যিনি গোটা জীবন লিখে গেছেন প্রতিবাদী গান। যিনি কমার্শিয়াল সাকসেসের পেছনে ছুটতে চাননি। যখনই সমাজের জন্য কিছু করার সুযোগ পেয়েছেন, আঁকড়ে ধরেছেন সেই সুযোগ। উনি নিজেকে বলতেন 'সিঙ্গিং জার্নালিস্ট'। ২০১৩ সালে একটি কনসার্টে বুড়ো নীল ইয়াং তাঁকে বলেছেন 'এই পৃথিবীর অন্যতম সেরা সং রাইটার, কবি'। তার নাম ফিল ওকস।

ষাটের দশকে উত্তাল সময়ে এক ঝাঁক সংরাইটাররা জমা হয়েছিলেন গ্রিনিচ ভিলেজে। সবার মুখে 'গ্যাসলাইট' ক্যাফের নাম। সমাজের উপর্যুপরি আঘাত সৃষ্টিশীল মানুষের মধ্যে থেকে বার করে আনছিল অসাধারণ সব কবিতা, গান, নাটক, ছবি। এলভিস প্রেসলিকে গুরু ভাবতেন ফিল ওকস। তিনি স্বপ্ন দেখলেন সং রাইটার হবেন। হয়তো এর মধ্যে দিয়েই খুঁজে পাবেন বেঁচে থাকার মানে। রোজকার সংবাদপত্রের মধ্যে উনি খুঁজে বেড়াতেন গান লেখার রসদ। উনি বলতেন - 'অল দ্য নিউজ ফিট টু সিং'। সিভিল রাইটস মুভমেন্ট, লেবার মুভমেন্ট, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ফিল ওকস লিখে গেছেন একের পর এক গান। ফিল পারফর্ম করলেন নিউপোর্ট ফোক ফেস্টিভালে। সেই ফেস্টিভালে বিখ্যাত হলেন বব ডিলান। একসময় ফিল বলেছিলেন - 'আমি বেস্ট সং রাইটার হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, ডিলানের গান শোনার পর আমি সেকেন্ড বেস্ট হতে চাই'।

ফিল ওকসের প্রথম দিকের অ্যালবামগুলি বেশ জনপ্রিয় হয়। শুধু একটি অ্যাকুস্টিক গিটার নিয়ে গাওয়া "Too many martyrs", “I ain’t marching anymore” গানগুলি সেইসময় ছিল খুবই প্রাসঙ্গিক। মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকে এসব গান। উনি লিখেছেন খনি শ্রমিকদের জন্য গান। “I ain’t marching anymore” গানটি যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের অ্যানদেম হয়ে ওঠে। ফিল লিখলেন - "Love Me, I'm a Liberal"। জোন বায়েজ গাইলেন ফিল ওকসের লেখা বিখ্যাত গান "There but for Fortune"। ফিল গান গাইছিলেন কিন্তু কমার্শিয়াল সাকসেস পাচ্ছিলেন না সেভাবে। খ্যাতিও সেভাবে পাননি। তখন বব ডিলান স্টার। কেউ কেউ মনে করেন ডিলান ফিল ওকসকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতেন। ফিলের একসময় মনে হয় যে ডিলান বড্ড বেশি কমার্শিয়াল হয়ে গেছে, সে নিজের জানলার বাইরে দেখতে ভুলে গেছে। ডিলান একবার ফিলকে তার লিমুজিন গাড়ি থেকে নেমে যেতে বলেন। ডিলান সেদিন ফিল ওকসকে বলে ছিলেন - "তুমি ফোক সংরাইটার নও, তুমি সাংবাদিক!"

কেনেডির মৃত্যু ফিল ওকস-কে আঘাত দিয়েছিল। আঘাত দিয়েছিল মারটিন লুথার কিং-এর মৃত্যুও। ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে ফিল গাইলেন 'ওয়ার ইজ ওভার'। গানের মধ্যে দিয়ে ফিল সেই ফ্যান্টাসির দুনিয়ার সন্ধান দিতে চেয়েছিলেন যেখানে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। ফিল কোনভাবেই নাম করতে পারছিলেন না। এই কষ্ট ভেতরে ভেতরে তাঁকে যন্ত্রণা দিতো। দীর্ঘদিন ধরেই ফিল ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ছিলেন। ফিল ওকসের কণ্ঠ ছিল অসামান্য। সেইসময়ের সং রাইটারদের মধ্যে এত ভালো পুরুষ কণ্ঠ ছিল বিরল। অনেক প্রটেস্ট সং লিখলেও, ফিল লিখেছেন Changes, When I’m Gone এর মতন অন্যধারার গান। 'Changes' গানটি ফিল ওকসের এক অসামান্য সৃষ্টি। অসামান্য সুর আর ফিল ওকসের মায়াময় কণ্ঠের যাদুতে এই গান অন্যমাত্রা পেয়েছে। মূলত E মেজর স্কেলে রেকর্ড করা এই গানে C#Minor এবং F#Minor কর্ড দুটির মধ্যে ফিল ওকস অদ্ভুত এক মেলানকলি ব্রিজ তৈরি করেছিলেন। যত দিন যাচ্ছিল মদ্যপান বাড়ছিল ফিল ওকসের। ডিপ্রেশন ভেতরে ভেতরে আরও শেষ করে দিচ্ছিল ফিলকে। নিজেকে একসময় বললেন - 'পৃথিবীর সব বিপ্লবেই একজন করে ক্লাউন থাকে। আমি হলাম সেই ক্লাউন'। ষাটের দশকের একদম শেষে এল্ভিস প্রেসলির মতন সোনালি স্যুট পরে পারফর্ম করলেন ফিল। দর্শকরা মেনে নিতে পারল না একজন প্রটেস্ট সংরাইটারের এই পাগলামি। এটাই হয়তো ছিল ফিল ওকসের খ্যাতি পাবার শেষ চেষ্টা। ফিল ওকস মনে করতেন, তার হয়তো মৃত্যু হয়ে গেছে, তিনি জাস্ট বেঁচে আছেন! ফিল ওকসের লেখা When I’m gone ইত্যাদি গানে সোচ্চার মৃত্যুচেতনার আভাস মেলে। আবার I've had her, she's nothing গানটি হয়তো সুইসাইডকে উদ্দেশ্য করে লেখা। ফিল তার ভাইকে বলেন, মৃত্যুর আগে তিনি এই পৃথিবীটা ভালো করে দেখতে চান। তখন ফিলের বয়স ত্রিশের একটু বেশি। তাহলে এখনই হঠাৎ মৃত্যুর কথা!

আরও পড়ুন
ওয়েস্ট ইন্ডিজে প্রথম ভারতীয় শিল্পী হেমন্ত, একশো গাড়ির কনভয় অনুসরণ করল তাঁকে

সাতের দশকের শুরুতে ফিল ওকসের সঙ্গে পরিচয় হয় চিলির বিখ্যাত প্রটেস্ট সংরাইটার ভিক্টর হারার। তখন চিলি উত্তাল। ফিলের মনে হয় ভিক্টর হারাই একজন সং রাইটারের আসল কাজটি করছেন। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু, চিলির পরিস্থিতি খুব দ্রুত খারাপ হতে শুরু করে। গ্রেপ্তার হন ভিক্টর হারা। বিরাট স্টেডিয়ামে অন্যান্য বন্দিদের সঙ্গে আনা হয় ভিক্টর হারাকে। সেখানে একজন সৈন্য ভিক্টর হারার দুটি হাত একটি টেবিলে রেখে বন্দুকের বাঁট দিয়ে আঙুলগুলি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। তারপর সেই সৈন্য অশ্রাব্য গালাগাল দিয়ে ভিক্টর হারাকে বলে - 'যাও এবার গিটার বাজিয়ে প্রতিবাদী গান গাও দেখি।' দীর্ঘ অত্যাচারে আহত ভিক্টর হারা সারা শরীর রক্তে ভেজা। তিনি উঠে দাঁড়ালেন, স্টেডিয়ামে উপস্থিত মানুষদের উদ্দেশ্যে রক্তে ভেজা দুই হাত তুলে বললেন - 'আসুন বন্ধুরা আমরা সবাই মিলে সালভাদোর অ্যালিয়েনদের দলের গানটি গাই'। স্টেডিয়ামে উপস্থিত মানুষেরা যোগ দেয় সেই গানে। তারপর সৈন্যরা পেছন থেকে গুলি করে ভিক্টর হারাকে। প্রায় ৪৪টি বুলেটের ক্ষত ছিল ভিক্টর হারার শরীরে। এই ঘটনার পর চিলির বিপ্লবীদের জন্য একটি কনসার্ট আয়োজন করেন ফিল। সেখানে ডিলান এসে গান গেয়েছিলেন। এইসময় আফ্রিকায় একটি বাজে ঘটনা ঘটে ফিল ওকসের সঙ্গে। দুজন ডাকাতের কবলে পড়েন তিনি। ফিলের ভোকাল কর্ডে আঘাত লাগে। ফলে, আগের মতন গলা আর রইল না ওঁর। অনেক নোট ধরতে পারতেন না। নিজের ভয়েস হারিয়ে আরও ডিপ্রেশনে চলে যান ফিল। উনি মনে করতেন এই ঘটনা আসলে সিআইএ করিয়েছে।

আরও পড়ুন
অভিমান বুকে নিয়েই অকালপ্রয়াণ আরডি-র, মৃত্যুর পর পেয়েছিলেন ফিল্মফেয়ার

ভিয়েতনামের যুদ্ধ শেষ হয়। ফিল ওকস যে ফ্যান্টাসির আভাস দিয়েছিলেন তাঁর গান 'ওয়ার ইজ ওভার'-এ, সেটি বাস্তবে পরিণত হয়। কিন্তু, ততদিনে ফিল ভেতরে ভেতরে একেবারে শেষ হয়ে গেছেন। মদ্যপান লাগামছাড়া, যাকে তাকে যা খুশি বলে দিচ্ছেন, জীবন ছন্নছাড়া। চলে গেলেন নিজের বোনের বাড়ি। সেখানে পিয়ানো বাজিয়ে অনেকবার গাইলেন তার 'জেমস ডিন অফ ইন্ডিয়ানা' গানটি। বারবার হয়তো নানান উপায়ে ডিপ্রেশন থেকে বেড়িয়ে আসতে চেয়েছেন ফিল। কিন্তু, কিভাবে যেন অনুভূতিগুলো জট পাকিয়ে যাচ্ছিল, যত বেশি জট ছাড়াতে চাইছিলেন তত বেশি জট পড়ে যাচ্ছিল! নিজের একাধিক বন্ধুকে বলেছিলেন, তাঁর বেঁচে থাকার অনীহার কথা। নীল ইয়াং ছিলেন সেই বন্ধুদের একজন। নিজের ভাইকে একদিন ফিল বলছিলেন - 'আমি নিজেকে শেষ করে দিতে চাই'। ভাই মজা করে উত্তর দিয়েছিলেন - 'তুমি তাহলে খাওয়া ছেড়ে দাও, এমনিই মরে যাবে।' ফিল হো হো করে হেসে ওঠেন। খেতে খুবই ভালবাসতেন ফিল। নিজের ভাইয়ের সঙ্গে এই কথোপকথনের পরের সপ্তাহে আত্মহত্যা করেন ফিল ওকস। তখন ফিলের বয়স মাত্র ৩৫। মৃত্যুর কিছুদিন আগে যেসব বন্ধুদের ফিল বলেছিলেন তাঁর সম্ভাব্য মৃত্যুর কথা, তাঁরা সকলেই আক্ষেপ করেন, যদি তাঁরা যদি আটকাতে পারতেন এই অসামান্য প্রতিভার আত্মহত্যা! টম প্যাক্সটন 'ফিল' নামক গানে লিখছেন - 

আরও পড়ুন
ফ্রয়েডের সঙ্গে দেখা করবেন রবীন্দ্রনাথ, সুপারিশের জন্য দ্বারস্থ গিরীন্দ্রশেখরের

'I opened the paper, there was your picture
Gone, gone, gone by your own hand
I couldn't believe it, the paper was shakin'
Gone, gone, gone by your own hand
I know I'm gonna spend
the rest of my lifetime wondering why
You found yourself so badly hurt you had to die’

আরও পড়ুন
মাইকেল জ্যাকসনকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন তাঁর চিকিৎসক?

ফিল হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন মৃত্যু তার পিছু নিয়েছে। তাই হয়তো তিনি লিখেছিলেন - 

‘And you won't find me singin'
on this song when I'm gone,
So I guess I'll have to do it while I'm here’

Powered by Froala Editor

More From Author See More