সুপ্রিম কোর্টে আইনত স্বীকৃতি পেল না সমলিঙ্গের বিবাহ, কোন ভবিষ্যতের ইঙ্গিত?

২০১৮ সাল। ৩৭৭ ধারা বাতিল করে সমলিঙ্গের সম্পর্ককে দণ্ডনীয় অপরাধের হাত থেকে নিষ্কৃতি দেয় সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court)। উভয়ের সম্মতিতে বিধিবদ্ধ করা হয় সমলিঙ্গের মানুষের একসঙ্গে থাকার অধিকার। সম্পর্ক নাহয় স্বীকৃতি পেল, কিন্তু আইনত বিবাহের অধিকার? উত্তর মেলেনি তখন। তারপর কেটে গেছে পাঁচ বছর। ২০২৩-এ এসে সমকামিতাকে স্বীকৃতি দিয়েও সমলিঙ্গ বিবাহের ক্ষেত্রে আইনি শিলমোহর দিল না সুপ্রিম কোর্ট। বরং বল চলে গেল কেন্দ্রের দিকে। আজ প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চে শুনানি হয় সমলিঙ্গের বিবাহ (Same Sex Marriage) সংক্রান্ত মামলার। বেশিরভাগ বিচারপতিই রায় দিয়েছেন সমলিঙ্গের বিবাহকে বৈধতা দেওয়ার বিপক্ষে। ফলে প্রশ্ন ওঠেই যে, ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে রইল ভারত?

২০২২-এ বিশেষ বিবাহ আইন-সহ আরো কয়েকটি বিবাহ আইনে সমলিঙ্গ বিবাহের অনুমতি চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন দাখিল করেন কয়েকজন সমলিঙ্গের দম্পতি। একই সঙ্গে বিভিন্ন হাইকোর্টেও চলছিল এই সংক্রান্ত মামলা। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে চলতি বছরের মার্চ মাসে শুরু হয় শুনানি। মে মাসে স্থগিত রাখা হয় রায়দান। আজ প্রধান বিচারপতির বক্তব্য অবশ্য কিছুটা ভিন্নপথের পথিক। বিবাহ কোনো অনড়, অটল বিষয় নয়। সংবিধানের জীবন ও স্বাধীনতার অধিকারের সূত্র ধরে জীবনসঙ্গী নির্বাচন মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু একমত হতে পারেননি পাঁচ বিচারপতি। আইন তৈরি বা বিশেষ আইন বদলের অধিকার নেই আদালতের। সেই মর্মে কেন্দ্র এবং সংসদের উপরেই ছেড়ে দেওয়া বিষয়টি।

কাদের উপরে? সেই সরকারের উপরে, যারা কিছুদিন আগেও বলেছে, সমলিঙ্গ সম্পর্ক একটি শহুরে হুজুগ। এই বিবাহকে স্বীকৃতি দিলে নাকি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের নাগরিকের স্বার্থ। ভারতের পরিবারের ‘পুরুষ’-‘নারী’-র ধারণা কিংবা ধর্মীয়-সামাজিক রীতিনীতি নাকি বিঘ্নিত হবে এক্ষেত্রে। সবচেয়ে বড়ো কথা, এই ‘সংস্কৃতি’ তো ভারতেরই নয়! আরএসএসের মহিলা শাখার রিপোর্টে তো সমকামিতা একটি ‘মানসিক ব্যাধি’। আইনজীবীদের সংগঠন থেকেও সংস্কৃতি-সভ্যতার যুক্তিতে বিরোধিতা করা হয়েছে সমলিঙ্গ-বিবাহের। আপাতত সেই সরকারের হাতে ঝুলে রইল ভবিষ্যৎ। তারা সমলিঙ্গের মানুষদের জন্য আইন বানাবে, রেশন কার্ড, গ্র্যাচুইটি, উত্তরাধিকারের বিষয় নিয়ে কমিটি বানাবে! এটাই কাম্য ছিল কি?

শুধু উপরমহলের দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। এই যে আজ রায় ঘোষিত হল, ফেসবুক-টুইটারে ছড়িয়ে পড়বে মতামত। তার কত শতাংশ আইনত বিবাহের সপক্ষে? সমীক্ষা করে লাভ নেই। উত্তরটা জানা। এবং হলফ করে বলা যায়, সেটাই সংখ্যাগুরু। এর মধ্যেই রয়েছে একটা চিরউদাসীন অংশ। বালিতে মুখ ডুবিয়ে ঝড় থেকে নিজেকে ‘সুরক্ষিত’ রাখার দাবিদার তারা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মতামত প্রকাশে অনিচ্ছুক, কারণ তারা তো ‘সমকামী’ নয়। রইল পড়ে সেই চিরাচরিত পুরুষ-নারী-সন্তানের যুক্তি। যে বিবাহে সন্তানের জন্ম হয় না, তাকে বিবাহ বলা যায় না। এমনটাই যুক্তি ছিল কিছু সংগঠনের। অর্থাৎ, লিঙ্গটাই শেষ কথা। সন্তান উৎপাদনই একমাত্র মোক্ষ। কে ‘পুরুষ’ আর ‘কে’ নারী, সেটা তো যৌনাঙ্গ দ্বারা নির্ধারণ করার বিষয়ই নয়। দুটো মানুষের একসঙ্গে থাকার স্বাধীনতা, মানসিক-শারীরিক সম্পর্কের পাশাপাশি আইনত একে-অপরকে সাহায্য করার প্রয়োজনীয়তা একুশ শতকের ভারতে নেই বলেই কি তবে মেনে নিতে হয়?

আরও পড়ুন
সমলিঙ্গ বিবাহকে আইনি স্বীকৃতি দিতে নারাজ কেন্দ্র, কী বলছেন বাংলার বিশিষ্টজনেরা?

আর সেজন্যই অবিলম্বে দরকার ছিল সমলিঙ্গ বিবাহের আইন। তাতে কি সামাজিক বৈষম্য কমত? ভ্রূ কুঁচকে তাকানো শূন্যে ঠেকত? নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু এই আইনের বদলে কতগুলি বিকল্প ব্যবস্থা আসলে একজন ভারতীয় নাগরিকের সার্বিক অধিকারকেই ক্ষুণ্ণ করে। আইনসিদ্ধভাবে বিবাহ না হলে দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে উঠতে পারে হাজারো বাধা। সেক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে নাম থাকবে একজনেরই। ভবিষ্যতে বঞ্চিত হতে হবে সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে। একই যুক্তি খাটে জীবনবীমা, স্বাস্থ্যবিমা কিংবা জয়েন্ট ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে। তাছাড়া, সমলিঙ্গের সম্পর্কে অনেকেই সাহায্য নিতে চান ‘সারোগেসি’-র। সেটাও কিন্তু পড়ে যাবে নানা আইনি সমস্যায়। পরিবারের তরফ আরেকটি অভিযোগ প্রায়শই ওঠে—অপহরণের। যেন একজন অপরজনকে জোর করে বা ফুঁসলিয়ে নিয়ে এসেছে তাঁর কাছে। আইন প্রণয়ন না হলে কোনোভাবেই নিরাপত্তা পাবে না এই সম্পর্কগুলি। আইনি প্রয়োজনীয়তা আছে, এই সমস্যাগুলির সঙ্গে লড়াই করার জন্যই আছে।

আরও পড়ুন
‘আইন, সমাজ সমলিঙ্গ বিবাহকে স্বীকৃতি দেয় না’, মন্তব্য কেন্দ্রের

কিন্তু আপাতত কঠিন হয়ে গেল সেই লড়াই। মিলল না অনেক প্রশ্নের উত্তর। পরবর্তী পদক্ষেপই বা কী? কেন্দ্রের বদান্যতার উপর নির্ভরশীল হওয়া নিশ্চয়ই নয়। বিশ্বের তিরিশটিরও বেশি দেশে স্বীকৃত সমলিঙ্গ বিবাহ। নিশ্চয়ই তা একদিনে আসেনি। সামাজিক, রাজনৈতিক, আইনত সব দিক থেকেই বাধা এসেছে যুগ-যুগ ধরে। তাহলে? উত্তরটা অপেক্ষা করে আছে আমি-আপনি কোন পক্ষ নিচ্ছি, তার উপরে। আজ না হয়, কাল কিন্তু এই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেবেই এক ‘অন্য’ ভারত...

মতামত লেখকের নিজস্ব

Powered by Froala Editor

More From Author See More