গত পরশু সকাল থেকেই আবহাওয়া দফতর সূত্রে খবর পাওয়া যাচ্ছিল, দঃ চব্বিশ পরগনার ওপর দিয়ে আমফানের ল্যান্ডফল করার সময় গতিবেগ থাকবে ঘণ্টায় দুশো কিলোমিটারেরও বেশি। গতকাল সকাল পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করেও স্থানীয় মানুষ বা থানা - কোথাও টেলিফোনে যোগাযোগ করা যায়নি। বসে না থেকে সকালে গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম সুন্দরবন গোসাবা ব্লক।
দ্বিতীয় হুগলি সেতু পার করে রেসকোর্সের সামনে আসতেই ঝড়ের তাণ্ডব কী হয়েছে, টের পেলাম। সুন্দরবন তো অনেকদূর, গোটা কলকাতাই তছনছ হয়ে গেছে। রেড রোড, এলগিন, এজেসি বোস রোড - সব রোড ব্লক, একদিকে কোনোমতে গাড়ি চলাচল করছে। এর পর মা ফ্লাইওভার ধরে ইএম বাইপাস উঠতে দেখলাম পরপর ত্রিফলা বাতি, ল্যাম্পপোস্ট, সিগনাল পোস্ট সব গড়িয়ার দিকে মুখ করে রাস্তার ওপর পড়ে আছে। বড়ো বড়ো বিজ্ঞাপনের ব্যানার আছড়ে পড়েছে এদিক সেদিক। বহু ল্যাম্পপোস্ট তার ছিঁড়ে বিপজ্জনক ভাবে ঝুলছে বা রাস্তায় পড়ে রয়েছে।
বাইপাস হয়ে কামালগাজি বারুইপুর ক্যানিং বাসন্তী রুট ধরে চুনাখালি হয়ে গোদখালি পৌঁছোই। রাস্তায় যেতে যেতে দুধারের গ্রামগুলো দেখছি কী অবস্থায় মানুষ রয়েছে। বহু গাছ ভেঙেছে, গছে থাকা কাক, শালিক ও নানা রকমের পাকি ডালের ভেতর ভেতর মরে আটকে রয়েছে। চোখের সামনে বিদ্যুতের ছিঁড়ে যাওয়া ল্যাম্পপোস্টে চাকা জড়িয়ে বাইক দুর্ঘটনা হল। গোদখালি পৌঁছানোর আগে চুনাখালি পেরিয়েই পড়ে হুগুল নদী। নদীর ওপর ব্রিজ, ব্রিজের নিচে দুটো সরকারি ট্রলারের আকৃতির বোট উড়ে এসে আছড়ে পড়েছে নদীর ধারে। আর দুটো মাছ ধরার ট্রলার হুগুল নদীর ব্রিজের পিলারে উড়ে এসে আছড়ে পড়েছে। এদিক ওদিক ছড়িয়ে নোঙর, প্রপেলারের ডানা, হালের বাঁট।
এরপর গোদখালি পৌঁছে লঞ্চঘাট। লঞ্চঘাটও ঝড়ে তছনছ। তার মধ্যেও একটা টিনের ঘরে বসে নিজের দায়িত্ব পালন করছেন সরকারি অনুমোদন প্রাপ্ত নজরদারির জন্য নিযুক্ত গ্রামীণ ডাক্তার ও সমাজসেবী ডঃ নিত্যানন্দ মন্ডল। করোনার জন্য প্রশাসনের তরফে সবার প্রবেশ নিষেধ, যাতে না কেউ পার হতে পারে তার জন্যই নজরদারি। ছাড় আছে চিকিৎসক, সাংবাদিক ও বিশেষ প্রয়োজনে যারা যাচ্ছেন তাঁদের। নিজেদের পরিচয় দিতে সব তথ্য নথিভুক্ত করে দেন উনি। অনেক কষ্টে একটা নৌকা পাওয়া গেল। নৌকা নিয়ে চারজন, আমি, বাদল জানা, অর্কেন্দু ভট্টাচার্য আর রাস্তায় আলাপ হওয়া স্থানীয় মানুষ ছাত্তার তরফদার।
সুন্দরবনে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত গোসাবা ব্লক। গোসাবা ব্লকের মধ্যে যে যে জায়গাগুলোর অবস্থা শোচনীয় সেগুলো হল দয়াপুর, সাতজেলিয়া, বালি (২), গোসাবা, মোল্লাখালি, রাঙাবেলা, আমলামেতি (১) ইত্যাদি। নিত্যানন্দবাবুর সহায়তায় নৌকায় ছাত্তারবাবুকে নিয়ে প্রথমে যাওয়া হয় গোসাবা দ্বীপে। বেশিরভাগ বাড়িই গাছ পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত, কারোর টিনের চাল উড়ে গেছে সেখানে কুড়িয়ে আনা প্লাস্টিক দিয়ে আটকানো হয়েছে। স্থানীয় মৃত্যুঞ্জয় মল্লিকের গোটা বাড়ি তছনছ হয়ে গেছে গাছ পড়ে। ঝড় হওয়া মাত্র মৃত্যুঞ্জয়বাবুর মতো যারা কাঁচা বাড়িতে থাকেন, তারা ভয়ে আশ্রয় নেন থানায়, বিডিও অফিসে, যাদের পাকা বাড়ি আছে তাদের বাড়িতে। মৃত্যুঞ্জয়বাবুর বাড়ির দেওয়াল হেলতে শুরু কিরেছে, যে-কোনো সময়ে পেছনের পুকুরে বাড়ি ভেঙে পড়বে।
সরেজমিনে গোসাবা দ্বীপ দেখে, মানুষের খোঁজ নিয়ে আবার নৌকা ডেকে গেলাম বালি ২ দ্বীপে। সন্ধে ঘনিয়ে আসায় অন্ধকারের মধ্যেই ঘুরে দেখতে হল। বালি দ্বীপের অবস্থা আরও শোচনীয়, বিদ্যাধরী নদীর মাঝে এই বালিদ্বীপে ভাঙনের হার সব থেকে বেশি, নবনির্মিত বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভয়াবহ ভাবে। চাষের জমি ও ফাঁকা জমিতে নোনা জল উঠে এসছে। স্থানীয় মাঝি পরিতোষ মন্ডল দেখাতে নিয়ে আসেন অভিজিৎ মাঝির বাড়ি। ভুল বললাম। বাড়ি ছিল, এখন আর নেই। গোটা কাঁচা বাড়িটাই ঝড়ে উড়ে চলে গেছে, শুধু দুটো চৌকি পড়ে আছে। ঝড় থামলে হাঁড়ি, করাই, খুন্তি পাওয়া গেছে পনেরো ফুট দূরে, ৫০০ টাকা খুচরো ছিল, তাও আর পাওয়া যায়নি। হারিয়ে গেছে ৪টে মুরগি, মারা গেছে দুটো ছাগল। ঝড়ের সময় বিপদ ঠাওর করতে পেলে মা বাবা স্ত্রী-কে নিয়ে যখন বাড়ি ছেড়ে পাশে কোথাও চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, সেই মুহূর্তে গোটা দেওয়াল ভেঙে পড়ে অভিজিৎবাবুর ওপর। পাঁজরের নিচে কাঠের তক্তাপোশ আর পিঠের ওপর গোটা দেওয়াল! এখনও ঠিক করে হাঁটতে পারছেন না।
এটা মাত্র দুটো অঞ্চলের চিত্র। গোটা সুন্দরবনের বহু জায়গায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রচুর। ঝড়ের কারণে এখনও বহু মানুষ ঘরছাড়া, আশ্রয় নিয়েছেন রেসকিউ সেন্টারে বা অন্যের বাড়িতে। যোগাযোগ ব্যাবস্থা একেবারে বিপর্যস্ত। নেই টেলিকমিউনিকেশনও। একজনেরও নেটওয়ার্ক নেই, সরকারি দফতরও অসহায়, শুধু হ্যাম রেডিওতে যেটুকু খবর আদানপ্রদান সম্ভব সেটুকুই হচ্ছে, জনসাধারণ একেবারে বিচ্ছিন্ন। ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে যেমন বহু গবাদি পশু মারা গেছে, বাড়ি ভেঙে ধূলিস্যাৎ হয়েছে, সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে তেমনি সামগ্রিক ক্ষতির মধ্যে নষ্ট হয়েছে বাঁধ, টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থা, জলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা এমনকি সড়ক পথে যোগাযোগ ব্যবস্থাও। পরিস্রুত পানীয়জল নেই, নেই বিদ্যুৎ। সব মিলিয়ে এক দুর্বিষহ পরিবেশ দেখে এলাম সুন্দরবনে।