ভূপৃষ্ঠের নিচেই লুকিয়ে রয়েছে ‘ষষ্ঠ’ মহাসাগর!

পৃথিবীর তিনভাগ জল, একভাগ স্থল— এমনটাই কৈশোরে থেকে শিখেছি আমরা। আর এই বিপুল জলরাশির ৯৭ শতাংশই সঞ্চিত রয়েছে পাঁচ মহাসাগর এবং অন্যান্য সমুদ্রে। বাকি ৩ শতাংশ পানযোগ্য জল পাওয়া যায় ভূগর্ভস্থ ভাণ্ডার এবং মেরু অঞ্চল ও পার্বত্য হিমবাহে। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী ভূপৃষ্ঠের ভেতরে লুকিয়ে রয়েছে আরও এক প্রকাণ্ড জলের ভাণ্ডার (Water Reservoir)। যা অনায়াসেই প্রায় ৩ বার ভরে ফেলতে পারে পৃথিবীর পাঁচ মহাসাগরকে। 

হ্যাঁ, শুনতে খানিকটা আজগুবি লাগলেও সত্যি। মাস কয়েক আগের কথা। পৃথিবীর এই ষষ্ঠ মহাসাগর (Sixth Ocean) সম্পর্কে একটি বিশেষ গবেষণাপত্র প্রকাশিত করেছিলেন গোয়েথে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। কিন্তু কীভাবে পৃথিবীর পেটের ভেতর লুকিয়ে থাকা এই মহাসাগরের নাগাল পেলেন তাঁরা? 

এই রহস্যের উত্তর লুকিয়ে রয়েছে বতসোয়ানা থেকে আবিষ্কৃত একটি হিরের মধ্যে। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪১০ কিলোমিটার গভীর থেকে উত্তোলিত হওয়া এই হীরক রত্ন হিসাবে খুব একটা মহামূল্য নয় মোটেই। তবে এই হিরের রাসায়নিক বিশ্লেষণ রীতিমতো চমকে দেয় বিজ্ঞানীদের। আর তার কারণ, শুধু কার্বন নয়, বরং এই হিরের স্ফটিকের মধ্যে রয়েছে জলের অণুও। এই আবিষ্কারই নতুন দিগন্ত খুলে দেয় গবেষকদের সামনে। 

শুধু বতসোয়ানার এই হিরেই নয়, প্রায় একই গভীরতা থেকে সাম্প্রতিক সময়ে আবিষ্কৃত হয়েছে ‘পেরিডট’ এবং ‘রিংউডাইট’ নামের আরও দুটি খনিজ। অবশ্য খনিজের তুলনায় তাদের স্ফটিক বলাই বেশি যৌক্তিক। কারণ, কারণ জলের অণুর সঙ্গে খনিজ অণুর বন্ধনের ফলেই জন্ম হয়েছে এই স্বচ্ছ ক্রিস্টাল বা স্ফটিকগুলির। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, ভূপৃষ্ঠে নিয়ে আসার পর দীর্ঘক্ষণ তাদের খোলা পরিবেশে রেখে দিলে, ভেঙে যায় এই স্ফটিক। আলাদা হয়ে যায় জল এবং মূল খনিজ। সেইসঙ্গে তৈরি হয় প্রচুর পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড।

সদ্য-আবিষ্কৃত এইসকল স্ফটিক ও হিরের আবিষ্কারের উপর ভিত্তি করেই ষষ্ঠ মহাসাগরের তত্ত্ব সামনে এনেছেন গবেষকরা। সাধারণত, ভূপৃষ্ঠের ৪০০-৬৬০ কিলোমিটার গভীরতার অঞ্চলটিকে বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করে থাকেন ট্রানজিশন জোন বা ‘পরিবর্তনশীল অঞ্চল’ নামে। এতদিন পর্যন্ত ধারণা করা হত, উচ্চতাপের কারণে এই অঞ্চলে জল থাকা সম্ভব নয়। তবে সদ্য-আবিষ্কৃত স্ফটিকগুলির আণবিক গঠন প্রমাণ করে দেয়, জল রয়েছে পৃথিবীর ট্রানজিশন জোনেও। যদিও তরল অবস্থায় সেই জল নেই। নেই বরফ বা জলীয় বাষ্পের আকারেও। বরং, তা উচ্চ চাপ এবং তাপে ভূগর্ভস্থ খনিজের সঙ্গে রাসায়নিক বন্ধন তৈরি করে পরিণত হয়েছে স্ফটিকে। 

তবে পৃথিবীর গর্ভে লুকিয়ে থাকা এইধরনের স্ফটিকের পরিমাণ নেহাত কম নয়। গবেষকদের মডেল অনুযায়ী, ট্রানজিশন জোন থেকে উত্তোলিত সমস্ত স্ফটিককে জলের অণুতে ভেঙে ফেললে তার মোট আয়তন হবে পৃথিবীর পাঁচ মহাসাগরের মোট আয়তনের প্রায় চার গুণ। তবে শুধুমাত্র জলের চাহিদা মেটাতে খনিজ উত্তোলনের কাজ মানুষের পক্ষে করা প্রায় অসম্ভব। বাণিজ্যিকভাবে তা লাভজনকও নয়। 

দীর্ঘসময় ধরে মনে করা হত, পৃথিবীতে জলের উৎস আদতে কোনো উল্কা কিংবা ধূমকেতু। পৃথিবীতে এধরনের মহাজাগতিক বস্তুর সংঘর্ষের ফলেই জন্ম হয়েছে জলের। তবে গোয়েথে এবং নিউ মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের তৈরি এই মডেল অনুযায়ী, পৃথিবীতে জল ছিল এই মহাজাগতিক সংঘর্ষের বহু আগে থেকেই। বরং, এই সংঘর্ষের কারণে বসে গিয়েছিল বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ভূত্বক। তৈরি হয়েছিল সমুদ্রগর্ভ বা ‘সিবেড’। অন্যদিকে চাপের তারতম্য হওয়ার ফলে স্ফটিক থেকে বন্ধনমুক্ত হয়ে ভূপৃষ্ঠের ফাটল দিয়ে জল বেরিয়ে আসে জল। তৈরি হয় মহাসাগর। 

এখনও পর্যন্ত এই গবেষণা সর্বস্তরে স্বীকৃতি না-পেলেও, এই তত্ত্বকে ফেলে দেওয়া চলে না মোটেই। এমনকি এই তত্ত্ব সত্যি হলে, সম্পূর্ণভাবেই বদলে যেতে পারে পৃথিবীর ইতিহাস। কাজেই আরও বিস্তারিত প্রমাণ সংগ্রহের আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন গবেষকদের একাংশ…

Powered by Froala Editor