কার্টুন আঁকলেন গগনেন্দ্রনাথ, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে হানা দিল পুলিশ

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঠাকুরবাড়ির এই সদস্যটির শিল্পী এবং সাহিত্যিক সত্তাটিই মানুষ বেশি করে চেনে। অবনীন্দ্রনাথের দাদা ও রবীন্দ্রনাথের ভাইপো – এই পরিচয়টিও নেহাত এড়ানো যায় না। কিন্তু তার বাইরেও যে তাঁর বহু গুণ ছিল তার খবর কে রাখে? তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে গিয়েছেন যা কিনা লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে গিয়েছে। সেরকমই কিছু টুকরো টুকরা ঘটনা ধরা রইল এখানে।


তখন কলকাতায় প্রথম ইলেকট্রিক এসেছে, এদিকে তার কোনো খরিদ্দার নেই! অর্থসম্পন্ন লোকেরা বাড়িতে ইলেকট্রিক নিতে ভয় পাচ্ছেন। কেউ ভাবছেন, তা আনতে গেলে বাড়ি বুঝি ছেঁদা করতে হবে। আবার কেউ শক্ লাগার ভয়েই আর সাহস করতে পারছেন না। গগনেন্দ্রনাথই প্রথম ব্যক্তি, যিনি বাড়িতে ইলেকট্রিক আনালেন। তাই দেখে একে একে অন্যদেরও সাহস বাড়তে থাকল, ইলেকট্রিকের প্রচলন হল শহরে। বাড়িতে ইলেকট্রিক আনায় কোম্পানির বিজ্ঞাপন হয়েছিল বলে গগনেন্দ্রনাথকে কোনো টাকাও জমা দিতে হয়নি।

নতুন নতুন জিনিসের প্রতি তাঁর ছিল ভীষণ ঝোঁক। বাজারে নতুন কী এল না এল সব খবর তাঁর ছিল নখদর্পণে। দোকানের মালিকেরাও জানতেন এ কথা, তাই কোনকিছু নতুন এলেই তাঁকে জানাতে ভুলতেন না। বিলিতি জিনিস না দেশি জিনিস তার বিচারও করতেন না। আবার এক জিনিস কখনও দুবার কিনতেন না, বাড়িতেই তার রেপ্লিকা তৈরি করে নেওয়ার চেষ্টা করতেন।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন পুরো দমে চলছে তখন। সাহেবদের গাড়িতে বোমা পড়ছে। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জেলে পোরা হচ্ছে পরপর। ঠিক এই সময় থেকে গগনেন্দ্রনাথ কার্টুন আঁকতে শুরু করেন। কোনো অজ্ঞাত কারণে পুলিশের ধারণা হয় যে, গগনেন্দ্রনাথও স্বদেশিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, আর তারই ফলস্বরূপ এই কার্টুন চিত্র। খবর এল, পুলিশ আসবে বাড়ি সার্চ করতে। যদিও বাড়িতে সেরকম কিছুই ছিল না এক ‘আনন্দমঠ’ ও এই জাতীয় কিছু বইপত্র ছাড়া। সেগুলোও গগনেন্দ্রনাথ সরিয়ে ফেললেন। পুলিশ এসে যথারীতি কিছু পেল না। আর মজার ব্যাপার হল যে, এরপর থেকে ঠাকুরবাড়িতে লাটসাহেবদের আনাগোনা বেড়ে গেল। তখনকার সময় এমন কোনো লাটসাহেব ছিলেন না, যিনি জোড়াসাঁকোতে যায়নি। এই সময় কারমাইকেল লাট হয়ে এলেন এবং তাঁর এতই গগনপ্রীতি জাগল (যদিও তাঁরা পূর্বপরিচিত ছিলেন) যে তিনি প্রায়ই আসতেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। এমনও দিন গেছে, যখন লাটভবন থেকে সেক্রেটারি ফোন করে জানিয়েছেন ‘ডিনারের টাইম হয়ে গেছে’, তখনও কারমাইকেল বলেছেন ‘একটু পরে যাব’। এমনই ছিল তাঁদের আড্ডাপ্রীতি।

উনিশ শতকের গোড়ায় একবার জোড়াসাঁকোতে কিছু জাপানি শিল্পীরা আসেন। তাঁদের পরনে ছিল কিমোনো জাতীয় পোশাক। গগনেন্দ্রনাথের নজরে আসে এই পোশাকটি। শিল্পীর মন সদাই নতুন ভবনার উদ্ভাবন করতে থাকে! তিনিও ভাবতে থাকলেন এই পোশাককে কী করে ভারতীয় পোশাকের মেলবন্ধন ঘটানো যায়। একের পর এক নকশা করতে করতে অবশেষে তাঁর মনের মতো একটি নকশা তৈরি হল। পাশ্চাত্য ফ্যাশনের সঙ্গে বাঙালিয়ানা মিলেমিশে এক হয়ে যায়।

পাশেই চিৎপুর, সেখানের এক দর্জিকে দিয়ে তৈরি করে ফেললেন তাঁর নকশা মতো দুটি পোশাক। আর এই পোশাক দেখে রবীন্দ্রনাথ এতটাই আকৃষ্ট ও মুগ্ধ হলেন যে, তিনি গগনেন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হলেন এবং এই নতুন ধরনের জোব্বা ও টুপি তৈরি করিয়ে নিলেন নিজের জন্য। তারপর থেকে এই পোশাকেই তিনি সব জায়গায় পরিচিত হন।

এইরকম আরো কত ঘটনা রয়ে গেছে। আর সেই সব ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন একজনই, তিনি ঠাকুরবাড়ির গগন ঠাকুর।

ঋণ-
১। ঠাকুরবাড়ির গগনঠাকুর-পূর্ণিমা দেবী,
২। ঠাকুরবাড়ির জানা অজানা- সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর।