শিষ্য জুডাসই ধরিয়ে দিল যিশুকে, মৃত্যুর আগে ৬ ঘণ্টা বিদ্ধ রইলেন ক্রুশে

দেখতে দেখতে চলে এল আরও একটা শুক্রবার। ক্যালেন্ডারের হিসেব অনুযায়ী, বছর শুরুর থেকে অনেকটাই এগিয়ে এসেছি। ভালো মন্দে কেটে যাচ্ছে সময়। কখনও নেমে আসছে প্রবল ঝড়, কখনও ঝলমলে রোদ। এই সমস্ত ভরসা, বিশ্বাসের মধ্যে মাথা তুলে আছে একটি ক্রুশ। যার গায়ে এখনও লেগে আছে রক্ত। গায়ে বিঁধে আছে পেরেক। জং পড়েনি একফোঁটাও। ওই ক্রুশের ওপর এইরকমই এক শুক্রবারে বিদ্ধ করা হয়েছিল জেরুসালেমের এক ব্যক্তিকে। গোটা বিশ্ব যাকে চেনে ‘যিশু’ নামে। তাঁর মৃত্যুর দিনটিকে স্মরণে রাখতেই পালন করা হয় ‘গুড ফ্রাইডে’।

‘লাস্ট সাপার’-এর পর যিশু আর তাঁর ১২ জন শিষ্য রাতের বেলায় হাজির হন জেরুসালেমের গেথসেমানে বাগানে। যিশু ছাড়া ওই দলের সবাই একটা অজানা আতঙ্কে কাটাচ্ছিলেন। কেন জানি না, সকলের মনে হচ্ছিল, বড়ো কিছু ঘটতে চলেছে। বড়ো কোনো দুর্ঘটনা। ওই দলেই আরও একজন ছিলেন, নাম জুডাস। তাঁরও ভয় করছে; কিন্তু কারণটি অন্য। সময় এগোল, রাত আরও গাঢ় হল। বাগানে অতর্কিতে যে আরও এক পক্ষ ঢুকে গেছে, সেটা জানতে পারলেন না কেউ। জুডাস এসে যিশুর গালে চুম্বন করলেন। হঠাৎ, আলো জ্বলে উঠল অনেকগুলো। অনেকগুলো চোখ চিকচিক করে উঠল। ওরা সৈন্য! পিটার, জন-সহ অন্যান্য শিষ্যরা সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলেন ব্যাপারটা। রুখে দাঁড়ালেন। এত বড়ো বিশ্বাসঘাতক হতে পারল জুডাস? কিন্তু তাঁরা জানতে পারলেন না, আগেই জুডাসকে ৩০টি রুপোর মুদ্রা দেওয়া হয় এই কাজটি করার জন্য। আর ওই চুম্বন সংকেত ছিল। হয়ত ছোটো লড়াইও হতে পারত; বাধা দিলেন স্বয়ং যিশু। তিনি যে শেষের মুহূর্ত দেখতে পেয়েছেন! সেনাদের হাতে ধরা দিলেন তিনি।

বাকি বর্ণনাটার কথা অনেকেই জানেন। যিশুর বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ আনা হল। তিনি নাকি নিজেই নিজেকে ‘রাজা’ ঘোষণা করেছেন। এটা মহান রোমান সম্রাট সিজারের অপমান। যিশুকে ধরে নিয়ে যাওয়া হল রোমান গভর্নর পন্টিয়াস পিলেটের কাছে। কিন্তু দীর্ঘ কথা বলার পরও তাঁর কোনো দোষ দেখতে পেলেন না তিনি। এদিকে জনতা রীতিমতো ফুঁসছে। তাঁদের দাবি, যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হোক; বদলে ছেড়ে দেওয়া হোক বারাব্বাসকে। যে বারাব্বাস একজন নিষ্ঠুর খুনি ছিলেন। শেষে জনতার দাবিই মানা হল। যিশুর মৃত্যুদণ্ডের কথা শোনালেন পন্টিয়াস।

এরপর শুরু হল অকথ্য অত্যাচার। চাবুক দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হল যিশুকে। তারপর মদ্যপ রোমান সেনারা তাঁর মাথায় পরিয়ে দিল কাঁটার মুকুট। অবশেষে সময় এলে, রক্তাক্ত অর্ধমৃত যিশুর কাঁধে তুলে দেওয়া হল ক্রুশকাঠ। যাতে লেখা ছিল, ‘নাজারেথের যিশু, ইহুদিদের রাজা’। গোটা রাস্তা কোনোক্রমে টানতে টানতে নিয়ে যান তিনি। রক্ত ঝরছে, সারা শরীর ঘেমে যাচ্ছে; আর জোর নেই। কিন্তু তাঁর পিতা যে অপেক্ষা করছেন! জেরুসালেম সীমানার বাইরে গলগথ পাহাড়ে অপেক্ষা করছে বধ্যভূমি। দুই হাতে আর পায়ে পেরেক বেঁধা হল। মোট ছয় ঘণ্টা ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন যিশু। ধীরে ধীরে আকাশ অন্ধকার করে মৃত্যু নেমে এল। যিশুর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল সেই বাক্য, “হে পিতঃ, এরা জানে না কী অন্যায় করছে। তুমি এদের ক্ষমা করে দিও।” গোটা তল্লাট কেঁপে উঠল ভূমিকম্পে; যিশুর দেহেও তখন প্রাণ নেই।

মনে করা হয়, যেদিন মারা গিয়েছিলেন, সেটি ছিল শুক্রবার। আর তাই আজও গোটা পৃথিবী জুড়ে পালিত হয় ‘গুড ফ্রাইডে’। কিন্তু ‘গুড’ কেন? এখানেই বলা যেতে পারে একটি লাইন- ‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান।’ যিশু নিজের ওপরই পৃথিবীর যাবতীয় দুঃখ, কষ্টের বোঝা নিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে তিনি সেগুলোকেও যেন নিয়ে যান। আমাদের ভালো করে যান। এই মৃত্যু দুঃখের; আবার এই মৃত্যু মুক্তিরও। এই পুরো সময়টাই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইস্টার পরবের প্রধান দিন হল ‘গুড ফ্রাইডে’। ঠিক তিনদিন পর, মেরি ম্যাগডালেনের সামনে এসে প্রকট হন যিশু। তাঁর ফিরে আসার সময়, রেজারেকশন। গুড ফ্রাইডের পরের রবিবারটিই তাই পরিচিত ‘ইস্টার সানডে’ হিসেবে। আর ইস্টার বলতেই আমাদের মাথায় আসবে নানা রঙের ডিমের কথা। ডিম ফুটে যেমন নতুন জন্ম হয় পাখির, সে তখন মুক্ত হয়ে যায়; তেমনই যিশুও সমস্ত জাগতিক বাধা থেকে মুক্ত হয়ে এইদিন আবার জেগে উঠেছিলেন।