ভুল চিকিৎসায় বিরল রোগের শিকার, হার না-মানা লড়াই কলকাতার তরুণীর

শিরদাঁড়া-জুড়ে অসহ্য যন্ত্রণা। বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না কিছুতেই। চলাচল করার সময়ও যন্ত্রণা বাড়ে পাল্লা দিয়ে। বয়স্কদের ক্ষেত্রে না হয় এমন ঘটনা দেখা গেলে, ব্যাপারটা অন্যরকম। কিন্তু ১৩ বছরের ছোট্ট শিশুর ক্ষেত্রে যদি এমন ঘটে?

স্কোলিওসিস (Scoliosis)। এই রোগের চরিত্র অনেকটা বাতের মতোই। তবে হাত বা পায়ের বদলে, এই রোগ থাবা বসায় মেরুদণ্ডে। সরে যায় মেরুদণ্ডের ডিস্ক। আজ থেকে বছর দশেক আগের কথা। এই বিরল রোগে ধরা পড়েছিল কুঁদঘাটের পূর্ব পুটিয়ারির বাসিন্দা সায়ন্তনী ঘোষের (Sayantani Ghosh)। অস্ত্রোপচারে তাৎক্ষনিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠলেও, সম্পূর্ণভাবে সেরে ওঠেননি সায়ন্তনী। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফের থাবা বসায় স্কোলিওসিস। 

২৩ বছর বয়সি সায়ন্তনী আজ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের ছাত্রী। তবে শারীরিক অসুস্থতার জন্য পড়াশোনা বন্ধ হয়েছে বছর খানেক আগে থেকেই। গত বছরের মাঝামাঝি সময় সেটা। নতুন করে শুরু হয়েছিল অসহ্য যন্ত্রণা। ফের শরণাপন্ন হতে হয় চিকিৎসকের কাছে। তবে এবার অস্ত্রোপচারের বদলে ওষুধকেই বেছে নিয়েছিলেন চিকিৎসক। ইএসআই। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যা পরিচিত এপিডিউরাল কোর্টিকোস্টেরয়েড ইনজেকশন নামে। উচ্চমাত্রার এই স্টেরয়েড নিয়ে চিকিৎসাজগতে বিতর্ক চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই। তবে একদিনেই সায়ন্তনীর শরীরে তিনটি ইএসআই ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করেন চিকিৎসক। 

না, সুস্থ হওয়া তো দূরের কথা, পাল্লা দিয়েই বেড়ে চলে সমস্যা। তবে হার মানেননি সায়ন্তনী। শুরু করেন গবেষণা। গবেষণা বলতে, ইএসআই-এর ভুল প্রয়োগের শিকার যাঁরা, সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁদের একজোট করার চেষ্টা শুরু করেন সায়ন্তনী। প্রথমত ভারতীয়, তার ওপর আবার স্বল্পবয়সী এক তরুণী— সাড়া দেয়নি অনেকেই। তবে তার মধ্যেও আশার আলো হয়ে ধরা দিয়েছিলেন মার্কিন নিবাসী এক প্রৌঢ় মহিলা। জেসিকা। কয়েকদিনের মধ্যেই জেসিকার সঙ্গে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। ইএসআই স্টেরয়েডের প্রভাবে কী ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পড়ে, তার থেকে কীভাবেই বা মুক্তি পাওয়া সম্ভব— এসবের ব্যাপারে জেসিকাই তথ্য প্রদান করেছিলেন সায়ন্তনীকে। 

তবে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি এই বন্ধুত্ব। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই বিদায় নেন জেসিকা। সেখান থেকেই শুরু হয় সায়ন্তনীর এক নতুন লড়াই। জেসিকার চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। সেখানে ধরা পড়ে অতিরিক্ত স্টেরয়েডের কারণে অ্যাঢেসিভ আরাকনোইডিটিস নামের অন্য এক শারীরিক সমস্যার শিকার সায়ন্তনী। যার প্রভাবে ক্রমশ ক্ষয়ীভূত হচ্ছে তাঁর মেরুদণ্ড। প্রভাব পড়ছে স্নায়ুতন্ত্রে। বয়সের সঙ্গে যা বাড়তে থাকবে ক্রমশ। পরিণতি মৃত্যু। কিন্তু এই নরক-যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায়?

চিকিৎসকের কথায়, একমাত্র স্টেম কোশের প্রতিস্থাপনেই সমাধান মিলতে পারে এই সমস্যার। জেসিকার ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়েছিল এই চিকিৎসা পদ্ধতি। তবে জেসিকার বয়সের জেরেই ফলপ্রসূ হয়নি তা। অন্যদিকে সায়ন্তনীর বয়স কম হওয়ায়, তা সাফল্য পাবে বলেই আশাবাদী চিকিৎসক। তবে অস্ত্রোপচারে দেরি হলে, সেরে ওঠার সম্ভাবনাও কমতে থেকে ধীরে ধীরে। 

তবে আশার আলো থাকলেও, দক্ষিণ কলকাতার নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের আর্থিক সামর্থ্যই বা কতটুকু? দীর্ঘদিন ধরে সন্তানের চিকিৎসার ভার বহন করতে করতেই পাহাড় জমেছে ঋণের। তারওপর এই অপারেশন করতে ৩২ লাখ টাকার খরচ। মুখের কথা নয় মোটেই। শেষ পর্যন্ত তাই হাল ছেড়েছিলেন সায়ন্তনীর বাবা-মা। শুধু হার মানেননি ২৩ বছর বয়সি তরুণী। বিগত কয়েক মাস সোশ্যাল মিডিয়াকে হাতিয়ার করে, অসুস্থ শরীরেই অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সায়ন্তনী। খুব কিছু সহজ ছিল না এই লড়াই। প্রথমত, ক্রাউড ফান্ডিং সাইট ‘কেটো’-তে আবেদন জমা দিতে গিয়েই একাধিক প্রতিবন্ধকতার শিকার হন তিনি। স্কোলিওসিস নামের আদৌ যে কোনো রোগ হয়, তা বিশ্বাস করেননি সংস্থার কর্মকর্তারা। সঙ্গে নিজের চিকিৎসার খরচের জন্য নিজেই আবেদন করায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় হাসি-ঠাট্টারও শিকার হয়েছিলেন সায়ন্তনী। না, মাথানত করেননি তিনি। বরং, এখনও চলছে তাঁর অদম্য লড়াই। অনেকে পাশে দাঁড়িয়েছেন, হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের। কিন্তু ৩২ লাখের ধারেকাছেও পৌঁছায়নি সামগ্রিক সাহায্যের পরিমাণটা। কী পরিণতি তবে শেষ পর্যন্ত?

না, সে-কথা জানা নেই কারোরই। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, এ-ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যা না-হয় আগামীতে, তার জন্য কি কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হবে না প্রশাসনিক স্তরে? সরকার-ই বা কেন মুখ ফিরিয়ে রয়েছে এধরনের ঘটনা থেকে? কেন-ই বা চিকিৎসার জগতে অনুপস্থিত সুনির্দিষ্ট কোনো গাইডলাইন? সায়ন্তনীর লড়াই যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে এইসব প্রশ্নের কথাই… 

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More