'গ্লুমি সানডে' - ১৯ জনকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছিল যে গান

পূর্ব ইউরোপের একটি দেশ হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট। বিদেশি পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্যস্থল। কিন্তু এক অন্ধকারময় অতীতের সাক্ষী একদা আত্মহত্যার নগরী নামে কুখ্যাত এই শহর।

সময়টা ১৯৩০-এর দশক। বুদাপেস্টে আত্মহত্যার হার ভয়ংকর ভাবে উর্ধ্বমুখী। সম্ভাব্য কারণ খুঁজতে গেলে তৎকালীন আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির দিকে ফিরে তাকাতে হবে আমাদের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পর বৃহত্তর অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের পতন ও হাঙ্গেরির স্বতন্ত্র অস্তিত্বলাভ। মাথাচাড়া দিয়েছে প্রবল অর্থনৈতিক মন্দা আর বেকারত্ব। মনে করা হয়, এই সংকট আত্মহত্যা বৃদ্ধির জন্য দায়ী।

বুদাপেস্টের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া দানিয়ুব নদীর জলে ঝাঁপ দেওয়ার ঘটনা দিনদিন বাড়ছিল। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে সরকার তাই দানিয়ুবের বুকে উদ্ধারকারী নৌকা টহল দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।

তবে, এসব ছাড়াও বেশকিছু অদ্ভুত রকমের আত্মহননের ঘটনার খবর পাওয়া যায় এসময়ে। যেমন এক মহিলার মৃতদেহ উদ্ধার হয়, সেসময় রেকর্ড প্লেয়ারে বাজছিল একটি গান। এক জুতোর কারিগরের মৃতদেহের পাশে সুইসাইড নোট হিসেবে পাওয়া যায় ওই গানেরই চারটি লাইন। এইরকম পরপর আরো কয়েকটি আত্মহত্যার ঘটনা। অনুসন্ধানে দেখা গেল, কোনো না কোনোভাবে এই গানটা জড়িয়ে আছে মৃত্যুর কারণ হিসেবে। সংখ্যাটা নেহাত কম নয়, প্রায় উনিশ।

অবাক হচ্ছেন? এতগুলো মৃত্যুর আততায়ী একটি গান?

হ্যাঁ, এটাই ঘটনা। যে গানটি নিয়ে এত চর্চা, সেটি হল ‘Gloomy Sunday’ অর্থাৎ বিষণ্ণ রবিবার! গানটির সুর দিয়েছিলেন হাঙ্গেরিয়ান পিয়ানোবাদক রেজসো সেরেস ও কথা লিখেছিলেন তার বন্ধু কবি লাজলো জাভর। একদিকে বান্ধবী-বিচ্ছেদ, অন্যদিকে ভাগ্যান্বেষণে দেশ ছেড়ে প্যারিসে এসেছেন - এইরকম এক অস্থির সময়ে, এই করুণ সুরের জন্ম দিয়েছিলেন সেরেস! ভালোবাসার মানুষের মৃত্যু এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনে মিলিত হওয়ার ইচ্ছার উপর আলোকপাত করা হয়েছে এই গানে। ১৯৩৫ সালে প্রথম এ গানটি হাঙ্গেরিয় ভাষায় রেকর্ড করেন পল ক্যামার। প্রবল জনপ্রিয়তা পায় গানটি এবং পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে আত্মহত্যার ঘটনা। হাঙ্গেরির রেডিও চ্যানেলগুলো নিষিদ্ধ করে গানটি। কিন্তু ততদিনে এ গান অনুবাদ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায়। সর্বাধিক জনপ্রিয় বিলি হলিডে সংস্করণটি ১৯৪৬-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিবিসি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। প্রায় ৬৬ বছর পরে, ২০০২ সালে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় বিবিসি। অবসাদের গান অনেক রচনা হয়েছে, কিন্তু এতগুলি মৃত্যুর কারণ হিসেবে একটি গান, এরকম উদাহরণ পৃথিবীতে বিরল।


১৯৬৫ সালে জাভর নিজে জানলা দিয়ে লাফ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন, পরে হাসপাতালে গলায় তার পেঁচিয়ে মারা যান। নিয়তির পরিহাস? হয়তো বা!

এদিকে এই সংক্রান্ত খবর ও গুজব এতটাই ছড়িয়ে যায় গোটা ইউরোপ ও আমেরিকা জুড়ে, যে বুদাপেস্ট আত্মহত্যার নগরী হিসেবে লোকমুখে প্রচারিত হয়ে যায়। এই আতঙ্কের পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রফেসর জেনো ও হিপনোটিস্ট বিঙ্কজো চালু করেন একটি স্মাইল স্কুল। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, প্রাণখোলা হাসি মানসিক চাপ অনেকটাই দূর করতে পারে এবং এর জন্য প্রয়োজন মানুষকে সঠিকভাবে হাসতে শেখানো। সদস্যপদের মূল্য ছিল ছয় সপ্তাহের কোর্সে ৫০০ ডলার।

মডেল হিসেবে ব্যবহার করা হত আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের বৈশিষ্ট্যসূচক হাসিকে। এছাড়াও ব্যবহার হত ক্লার্ক গেবল, লরেটা ইয়ং, ডিক পাওয়েল এবং অবশ্যই রহস্যজনক হাসির মালকিন মোনালিসার হাসিকে! শিক্ষার্থীদের পরানো হত বিভিন্ন ধরনের হাসির মুখোশ। ডাচ ম্যাগাজিন হেট লেভেন প্রথম এই ঘটনা ছাপে। এর আমেরিকান সহযোগী পত্রিকা 'লাইফ' বেশ কিছু ছবি ছাপায়। কিন্তু আদৌ এই ধরনের কোনো স্কুলের অস্তিত্ব ছিল কিনা, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। অনেকেই মনে করেন, এটি আসলে ভাঁওতা, আমেরিকান রিপোর্টারদের বানানো গল্প। একটি ছবিতে দেখা যায় রুজভেল্টের ছবিকে ঘিরে, অদ্ভুত হাসির মুখোশ পরে বিভিন্ন বয়সের নরনারীর ছবি। ফটোগুলোতে মানুষজনের পোশাক ও হাসির মডেল হিসেবে আমেরিকান কলাকুশলীদের ব্যবহার এই সন্দেহকে আরো গাঢ় করে।

সত্যি বা মিথ্যা যাই হোক, সিটি অফ সুইসাইড থেকে সিটি অফ স্মাইলের এই যাত্রাপথ - ইতিহাসের পাতায় একটি কিংবদন্তী হিসেবে ঠাঁই করে নেবে!

Powered by Froala Editor

More From Author See More