এক বাঙালির হাতেই শুরু আমেরিকার প্রথম পুরুষ স্ট্রিপ ক্লাব

লস অ্যাঞ্জেলস। হলিউডের শহর। রাতের মায়াবী আলোয় সঙ্গী হয় উদ্দামতা। মদের গ্লাসে ছলকে ওঠে আদিম রিপু। আকাশে ওড়ে টাকা। তার উষ্ণ পরশে নাচতে থাকে পুরুষ-মহিলা। রাস্তার উপরে সারি সারি দাঁড়িয়ে স্ট্রিপ ক্লাব। এখানে জীবনের অর্থ খোঁজা হয় শরীরী আবেদনের মাপকাঠিতে। পুরুষদের ক্ষুধার্ত চোখের সামনে উন্মুক্ত হতে থাকে নারী শরীর। তবে একটি ক্লাবে চলে বিপরীত ঘটনা। এখানে বিনোদনের ‘পণ্য’ পুরুষ। তাদের রগরগে ভঙ্গিমায় দৃষ্টিসুখ খুঁজে নিচ্ছেন অসংখ্য মহিলা। এই ক্লাবের মালিকের নাম স্টিভ। পদবি ব্যানার্জি। হ্যাঁ, এক বাঙালির হাতেই শুরু হয়েছিল আমেরিকার প্রথম পুরুষ স্ট্রিপ ক্লাব।

আসল নাম সোমেন ব্যানার্জি (Somen Steve Banerjee)। ১৯৪৬-এ মুম্বইতে জন্ম। মুম্বইয়ের রাস্তায়, জুয়ার আড্ডায় কাজ করে টাকার নেশা লেগে যায় চোখে। মাথার মধ্যে কিলবিল করতে থাকে দুরন্ত সব বুদ্ধি। কিন্তু সম্ভব নয় এদেশে। যেতে হবে আমেরিকা, ওদেশে টাকা ওড়ে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে আমেরিকার পথে রওনা হলেন সোমেন। না, এখন তাঁর নাম স্টিভ। বিদেশের মাটিতে উন্নতি করার প্রথম ধাপটি সহজেই আয়ত্ত করে নিলেন মিঃ ব্যানার্জি। 

প্রথমে অবশ্য সুবিধা করতে পারলেন না খুব একটা। অচেনা মাঠে আনকোরা খেলোয়াড়। কিছুদিন কাটল গ্যাস স্টেশনে কাজ করে। কিন্তু এখানে বন্দি থাকতে তো এতটা পথ পাড়ি দেননি। চলতে থাকে টাকা উপার্জনের নানারকম ফন্দিফিকির। মাঠ অচেনা হলেও খেলার পরিধিটা বড়ো। আর সবচেয়ে বড়ো খেলাটা চলে নাইটক্লাবগুলিতে। এক রাতের সুখের জন্য ভাসানো হয় লক্ষ লক্ষ ডলার। শুধু টান দিতে হবে পুতুল নাচের সুতোয়। সামাজিক মানুষের অন্ধকার দিকগুলিকে ফেলতে হবে ফাঁদে।

মানবচরিত্র চিনবেন বলেই তো সাত সমুদ্র পার করা। ঠিক করলেন, নামতে হবে নাইটক্লাবের ব্যবসায়। ‘ডেস্টিনি ২’ নামের একটি লোকসানে চলা ক্লাব ১৯৭০ সালে কিনে শুরু হল যাত্রা। বাজি রাখলেন সর্বস্ব। এখানে সারা রাত ধরে রয়েছে ম্যাজিক শো, জুয়া খেলা এবং মহিলাদের লাস্যময়ী নাচের বন্দোবস্ত। ছিল আরেকটি বিশেষ আকর্ষণ। কাদার মধ্যে নারীদের মল্লযুদ্ধ। স্বল্পবসনা সুন্দরীরা জলে-কাদায় সিক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই করছে। আঁচড়ের দাগে ছিঁড়ে যাচ্ছে পোশাক। আর উত্তেজনায় রক্ত ছলকে ওঠা পুরুষ দর্শকরা বাজি ধরছেন পছন্দের যোদ্ধার জন্য। 

আরও পড়ুন
কার্ডবোর্ডের বাক্সে লুকিয়ে আমেরিকা থেকে ইংল্যান্ড, ‘রোমাঞ্চকর’ মুক্তির গল্প

তবে আস্তিনের শেষ তাসটি খেলা তখনও বাকি ছিল স্টিভের। বুদ্ধিটা দেন পল স্নাইডার নামের এক কোরিওগ্রাফার। ১৯৭৯-এ চালু করলেন নতুন ধরনের স্ট্রিপ ক্লাব। এবার নাচবে পুরুষ, আর দর্শক হবেন মহিলারা। হতে পারে নিছকই মুনাফার জন্য, কিন্তু খোদ আমেরিকার বুকে পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার সংজ্ঞাটা নিয়ে তুলে দিলেন প্রশ্ন। ভোগ্যপণ্যের তালিকায় উঠে এল পুরুষের লিঙ্গপরিচয়। ক্লাবের নাম পালটে রাখেন ‘চিপেনডেলস’।

আরও পড়ুন
সান্তা যখন মহিলা, আমেরিকায় নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন মিসেস ক্লজ

দিনের আলো ঢলতেই শুরু হয় ‘চিপেনডেলস’-এর (Chippendales) জাদু। ক্লাবের মধ্যভাগে চলে পুরুষ স্ট্রিপারদের নাচ। পেশীবহুল তৈলসিক্ত শরীর, উর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। ধীরে ধীরে খসে পড়ছে বাকি আবরণও। তাদের ঘিরে আছে কয়েকশো মহিলা। স্ট্রিপাররা ছিটকে চলে যাচ্ছে অতিথিদের সামনে। কারোর পাত্রে ঢেলে দিচ্ছে মদ, জ্বালিয়ে দিচ্ছে সিগারেট। স্পর্শে মাতাল করে ফিরে যাচ্ছে নিজের নাচের জায়গায়। ফুলে ফেঁপে ওঠে নাইটক্লাবটি। আশির দশকে প্রতিদিনের আয়ের পরিমাণ ছিল ২৫০০০ ডলার। প্রতি বছরের ব্যবসা ছিল ৮ মিলিয়ন ডলার।

১৯৮০-তে আইরিন নামের এক আমেরিকানকে বিয়ে করেন স্টিভ। ততদিনে তিনি একা হাতে বদলে দিয়েছেন আমেরিকার অ্যাডাল্ট ইন্ড্রাস্ট্রিকে। আশেপাশে গড়ে ওঠে প্রতিদ্বন্দ্বী। ঘনাতে থাকে বিপদ। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন কয়েকজন স্ট্রিপার। ফিকে হতে থাকে ‘চিপেনডেলস’-এর জাদু। বাধ্য হয়ে স্টিভ শুরু করেন ষড়যন্ত্র। ভাড়াটে গুন্ডা লাগিয়ে আশেপাশের ক্লাবগুলিতে লাগিয়ে দেন আগুন। বাজারে তখন পুরুষদের শ্রেষ্ঠ কোরিওগ্রাফার নিক ডি নোইয়া। অবস্থা ফেরাতে বিশাল অঙ্কের টাকার প্রস্তাব দেন তাঁকে। 

আবার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘চিপেনডেলস’। কৃতিত্বের দাবি করেন নিক। মিডিয়ার নজর ঘুরে যায় শ্বেতাঙ্গ শিল্পীর দিকে। কালো চামড়ার মানুষ কিনা রাতের আমেরিকার ‘বেতাজ বাদশা’ হবেন? শুরু হয় বচসা। ক্লাব ছেড়ে দেন নিক। তাহলে কি হার মানতে হবে স্টিভকে? তুলে দিতে হবে স্বপ্নের চিপেনডেলস-কে? না। কিন্তু এত সহজে এই বিরাট সাম্রাজ্য ছাড়বেন না। রাগে আর ঈর্ষায় ভাড়া করেন গিলবের্তো রিভেরা লোপেজ নামের এক ‘সুপারি কিলার’-কে। ১৯৮৭-র ৭ এপ্রিল দুপুরে নিজের অফিসে গুলি করে খুন করা হয় নিককে।

১৯৯৩-এ স্টিভের ২৬ বছরের কারাদণ্ড হয়। কিন্তু পরের বছর জেলকক্ষেই গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন স্টিভ ব্যানার্জি। এবারও আইনের ফাঁক গলে পালালেন। চিরকালের জন্য। মুম্বইয়ের গলি থেকে উঠে রাজত্ব করেছেন হলিউডের রাজপথে। তাঁকে শাস্তি দেবে কে? সমাজ? আইন? দুনিয়াকে দেখিয়েছেন সামাজিক মানুষের শারীরিক ক্ষুধার নতুন স্বরূপ। আইনের হাতের নাগালেই চালিয়েছেন ব্যবসা। ইতিহাস হয়তো ‘স্বর্ণাক্ষর’-এ মনে রাখবে না সোমেনকে। কিন্তু লস অ্যাঞ্জেলসের রাত্রিবাসরের লাল-নীল আলোর অন্ধকার ছায়ায় লেখা থাকবে স্টিভ ব্যানার্জির নাম।

Powered by Froala Editor