'রাজাকার' কাকাকে যথাযোগ্য শাস্তি দিয়েছিল 'মুক্তিযোদ্ধা' কিশোর

দ্বিতীয় পর্ব

‘তারপর তো ৩ ডিসেম্বর অফিশিয়ালি যুদ্ধ শুরু হল। আমাদেরও প্রকাশ্যে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করতে আর কোন বাধা রইল না। কিন্তু সমস্যা ছিল অন্য। পাক বাহিনী যখন বুঝে গিয়েছিল যে রিট্রিট করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই, পালানোর পথে যত্রতত্র অ্যান্টি পার্সোনাল মাইন ছড়িয়ে গিয়েছিল। সেই মাইন ছড়ানো ছিল রেললাইনের পাশে, রাস্তার দু’ধারে এমনকি রেললাইনের ওপরেও। আমাদের কাছে তখন মাইন ডিটেক্টর ছিল না। একটা একটা করে মাইন খুঁজে আমরা অগ্রগতি জারি রাখব – এ ছিল খুবই মুশকিলের ব্যাপার। কী করা যায়?

আমাদের বাহিনীর এক সদস্য প্রস্তাব দিল, সশস্ত্র প্রহরায় রেললাইনের দু’পাশে ও রাস্তার ধারে রাজাকারদের হাঁটিয়ে দেখা যাক। কয়েকদিন আগে যে রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করেছিল, তাদেরই হাত বেঁধে হাঁটালাম আমাদের পাশে-পাশে। এভাবে মাইনমুক্ত করা হল আমাদের চলার পথ।’

প্রথম পর্ব
‘খড়ের চাল ফুঁড়ে, খাবারের প্লেটে এসে পড়ল পাকিস্তানি সেনার গুলি’

অবাক হয়ে শুনছি তাঁর কথা। তিনি, মানে সমীর মিত্র। ১৯৭১ সালে বিএসএফের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমান্ডান্ট। পোস্টিং ছিল কোচবিহারের শীতলকুচি ও গিতালদায়। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা হওয়ার পর, প্রবেশ করলেন পূর্ব পাকিস্তানে। চারদিকে পাক বাহিনীর নারকীয় সংহারের চিহ্ন। তারপর? আর কী দেখলেন তিনি?

‘ওপারে এগোতে এগোতে দেখি, অসংখ্য অস্ত্রশস্ত্র ফেলে গেছে পাকিস্তানি সেনারা। শুধু আমার ওখানে নয়, বিভিন্ন জায়গাতেই। চাইলে আরও ছ’মাস আমাদের আটকে রাখতে পারত ওরা এত অস্ত্র দিয়ে। আমরা ওখান থেকে চারটে বড় টাটার গাড়ি ভর্তি অস্ত্র উদ্ধার করে পাঠিয়েছিলাম পেছনে, ভারতে।

ইতিমধ্যে, কোচবিহার থেকে মোগলহাট হয়ে লালমনিরহাট পর্যন্ত রেললাইন রি-কানেক্ট করার দায়িত্ব এসেছিল আমার ওপর। আলিপুরদুয়ারের ডিআরএম আমার কাছে এসেছিলেন, সঙ্গে ছিলেন চিফ ইঞ্জিনিয়ার, চিফ সেফটি অফিসার, মেকানিক – সকলেই। আমাদের অনুরোধ করেছিলেন সহযোগিতার জন্য। যুদ্ধক্ষেত্রে সাপ্লাই লাইন বজায় রাখার জন্যেই এই রেল যোগাযোগ চালু করার প্রয়োজন ছিল। শেষ অবধি লাইন চালু হল লালমনিরহাট পর্যন্ত।

মোগলহাট দখল করার পর, আমরা এগোচ্ছি সামনে, লালমনিরহাটের দিকে। লালমনিরহাটে বাংলাদেশে রেলওয়ের অন্যতম বড় হেড কোয়ার্টার ছিল। হঠাৎ দেখি, হঠাৎ এক পাক সেনা শুয়ে আছে এলএমজি নিয়ে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু খানিক বাদে দেখলাম, লোকটার হাতে এলএমজি থাকা সত্ত্বেও আমাদের দিকে ফায়ার করল না। সন্দেহ হল, বেঁচে আছে তো আদৌ? আস্তে আস্তে আমরা কয়েকজন সামনে গেলাম। গিয়ে দেখি, তার একটা পা উড়ে গেছে। হাঁটার কোনো প্রশ্নই নেই। লোকটা বলছিল – ‘সাব, মেরেকো ইঁয়াহা ফেককে চলা গেয়া হাতিয়ার দেকে, আপলোগ যব আওগি, গোলি করনে কে লিয়ে। ম্যায় নেহি কিয়া। ইয়া তো হামে মার দো, নেহি তো হামে পিছে ভেজ দো।’ আমি কোনোদিন ওয়ান্ট অ্যান্ড কিলিং-এ বিশ্বাস করিনি। এই লোকটার তো আর কিছুই করার ক্ষমতা নেই, সুতরাং একে মেরে আমার লাভ নেই। একটা স্ট্রেচার বানিয়ে, ওই আহত পাক সেনাকে পিছনে পাঠিয়ে দিলাম আমরা।

লালমনিরহাটে, শার্ট আর লুঙ্গি পরা একটা ছেলে এসে সাবধান হয়ে উইশ করল। ছেলেটা লেফটেন্যান্ট রহমান। বাঙালি। পাক আর্মিতে ছিল, কিন্তু ওখানে বিদ্রোহ করে ফিরে এসেছে নিজের গ্রামে। স্থানীয় ছেলে। আমাদের সাহায্য করতে চাইল। এখানকার পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের। সঙ্গে নিলাম ওকেও।

লালমনিরহাট থেকে খানসেনারা চলে যাওয়ার পর, পলাতক গ্রামবাসীরা ফিরতে শুরু করেছে একে একে। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে আছে গোটা এলাকা। এর আগে লালমনিরহাটের এয়ারফিল্ড আমরা ধ্বংস করে দিয়েছিলাম, ভারত থেকেই মর্টার, স্মল আর্টলারি ইত্যাদি ছুঁড়ে। যাইহোক, লালমনিরহাটে আমরা দু’দিন হল্ট করব ভেবেও, একরাত থেকেই এগোলাম। কেননা পাক আর্মিরা এগিয়ে গেছে আরও। ঠিক করলাম, Let us chase them, so that they can’t settle down somewhere. আমাদের বাহিনীতে দেড়শো জন মতো ছিল। এছাড়াও মর্টারের প্লাটুন, এমএমজি-র প্লাটুন ইত্যাদি ছিল সঙ্গে।

রাস্তার দু’ধারে ধ্বংসের ছবি। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। মৃতদেহ পড়ে আছে। উলঙ্গ মেয়েদের দেহ এখানে-ওখানে ছড়ানো। এই যে নারকীয় দৃশ্য, এটা কোনো সভ্য দেশ সভ্য আর্মি করতে পারে না।’

শুনতে শুনতে শিউরে উঠছি আমরাও। এর আগেও পাক সেনার অত্যাচারের কথা পড়েছি বিভিন্ন বইয়ে। একাধিক ডকুমেন্টরিতেও দেখেছি সেই দৃশ্য। কিন্তু সমীরবাবু নিজের চোখে দেখেছিলেন সেসব, ১৯৭১-এ। তাঁর বর্ণনা যত না অবাক করছে, তার থেকে বেশি আতঙ্কিত করছে আমাদের। আমরা যারা বাড়িতে বসে যুদ্ধের খবর পেয়ে কিংবা টিভিতে সরগরম আপডেট দেখে অভ্যস্ত, খোদ যুদ্ধক্ষেত্রের এই বর্ণনা কি সহজে নিতে পারি! সমীরবাবুর কথার মধ্যে দিয়ে, এই স্মৃতিচারণের বিকেলেই যেন শুনতে পারছি মার্চের শব্দ। লেফট রাইট লেফট... তারপর? পাক বাহিনীর দেখা মিলল?

‘লালমনিরহাট থেকে কাউনিয়া পৌঁছোলাম আমরা, ১১ বা ১২ ডিসেম্বর। কাউনিয়া খুবই বর্ধিষ্ণু জায়গা, তিস্তার এপারে। নদীর ওপারে রংপুর। কাউনিয়াতে একটা স্কুলে আমরা আশ্রয় নিলাম। ঘরের মধ্যে বিবস্ত্র মহিলারা মৃত পড়ে রয়েছেন। গ্রামের লোকেদের ডেকে, যথাযোগ্য মর্যাদায় তাঁদের কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বললাম। তারপর নিজেদের জন্য লিনিয়ার ডিফেন্সের ব্যবস্থা করে নিলাম। আমার সঙ্গে ততদিনে যোগ দিয়েছে একটা আর্টেলারি ব্যাটারি। মোর্চা শেষ করে, গ্রামের লোকেদের ডেকে বাড়ি ফিরতে বললাম, এবং প্রত্যেককে নিজেদের বাড়িতে সুরক্ষার জন্য মোর্চা তৈরি করে রাখতে বললাম যাতে গোলা উড়ে এলে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে পারে।

১৬ তারিখ সকালে জেনারেল ম্যানেকশা কয়েক ঘণ্টার সিজ ফায়ার ডিক্লেয়ার করলেন, অর্থাৎ পাক বাহিনীকে বলা হল, তোমরা ঠিক করে নাও সারেন্ডার করবে কি করবে না। সিজ ফায়ার মানে যুদ্ধবিরতি। কোনো পক্ষই গোলা চালাবে না। সেই ভেবেই, আমি দুটো এমএমজি মোর্চার ওপর দাঁড়িয়ে বায়নাকুলার দিয়ে উল্টোদিকে পাক আর্মিদের দেখছি। আমার সঙ্গে রয়েছেন আমার মর্টার প্লাটুন কমান্ডারও। হঠাৎ তিস্তার ওপার থেকে ওদের এইচএমবি ফায়ার শুরু করল। আমি আর আমার প্লাটুন কমান্ডার সঙ্গে সঙ্গে মোর্চায় লাফিয়ে নামলাম। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেও যে ওরা গুলি চালাবে, ভাবতে পারিনি। অবশ্য আমারই ভুল হয়েছিল। পাকিস্তানকে বিশ্বাস করা উচিৎ হয়নি। কান ঘেঁষে বেঁচেছিলাম তখন।

তারপর আমার আর্টেলারি ব্যাটারি কমান্ডারকে নির্দেশ দিলাম - ‘পুরা ঠোকো। সারেন্ডার উসকো করনা হি হ্যায়, অউর আজ হি করেগা। এবং তারপর আমরা ফায়ার করা শুরু করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখি, ওপাশ থেকে কেউ সাদা গেঞ্জি, কেউ আবার লুঙ্গি হাওয়ায় উড়িয়ে দেখাতে আরম্ভ করেছে। আমি নির্দেশ দিলাম গোলা চালিয়ে যাওয়ার। সাদা পতাকা অগ্রাহ্য করতে চাইলাম আমি। কারণ তারাই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছিল প্রথমে।

https://youtu.be/tDcjpNO7o4Q

ইতিমধ্যে, আমাদের কমান্ডার মিঃ জোসেফ সাইমন কোচবিহার থেকে এসে হাজির হলেন। যেহেতু কমান্ডিং অফিসার এসেছেন, আমি পিছিয়ে এসে ওঁর সঙ্গে দেখা করলাম। জানালাম, পাক সেনারা সাদা পতাকা দেখাচ্ছে এবং সারেন্ডার করতে চায়। আমি ওদের সঙ্গে কথা বলতে যাওয়ার অনুমতি চাইলাম। আমায় যেতে মানা করলেন মিঃ সাইমন। বললেন অন্য কাউকে পাঠাতে। রাজি হইনি আমি।

পাক আর্মির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হু ইজ দ্য কমান্ডার?’ ওটা ছিল পাকিস্তান আর্মির ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। একজন ক্যাপ্টেন বেরিয়ে এল। জিজ্ঞেস করলাম, সারেন্ডার করতে চায় কিনা। বলল, হ্যাঁ। নির্দেশ দিলাম, সব অস্ত্র ফেলে দিয়ে, নৌকো করে তিস্তার অপর পারে কাউনিয়ায় আসতে। কারোর কাছে যদি অস্ত্র পাওয়া যায়, সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলব তাকে।

তিস্তা পেরিয়ে কাউনিয়ায় এল তারা। জনা পঁচাত্তর সেনা ছিল ওদের। আত্মসমর্পণ করার পর, চোখ-হাত বেঁধে কাউদিয়াতেই রেখে দিলাম, যতক্ষণ না ইন্ডিয়ান আর্মির অর্ডার আসে। ওদের ক্যাপ্টেন অনুরোধ করল, যেন মুক্তিবাহিনীর হাতে যেন না দেওয়া হয়। আমি বললাম, সে-কথা আমি দিতে পারব না। কিন্তু যেহেতু ওরা আত্মসমর্পণ করেছে এবং যুদ্ধাপরাধী, প্রোটোকল মেনেই যা হওয়ার হবে। তারপর, অর্ডার এলে, ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দিলাম ওই পাক সেনাদের।

এরপর, ২৫ ডিসেম্বর আমায় ফিরে আসতে হল অসহ্য পেটে ব্যথায়। দু’দিন অজ্ঞানও হয়ে ছিলাম। জ্ঞান ফিরতে দেখি লালমনিরহাট হাসপাতালে আমি, আমার মায়ের বয়সি এক ভদ্রমহিলার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। চারদিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ডাক্তার, শুভাকাঙ্ক্ষীরা সকলে। কেউ আশাই করেনি, বেঁচে ফিরব। আসলে হয়েছিল মারাত্মক জন্ডিস। তারপর লালমনিরহাট থেকে কোচবিহার এলাম এবং সেখান থেকে কলকাতায় এসে চিকিৎসা করিয়ে সেরে উঠলাম আস্তে আস্তে।’

লম্বা শ্বাস নিলেন সমীর মিত্র। তৎকালীন অ্যাসিস্টান্ট কমান্ডার। শ্বাস নিলাম আমরাও। যুদ্ধ শেষ হল তাহলে! তাঁর কথাও কি ফুরোল?

‘একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। তখনও যুদ্ধ শুরু হয়নি অফিশিয়ালি। আমি তখন শীতলকুচিতে। এক মুক্তিযোদ্ধা, বয়স বড়জোর আঠেরো-উনিশ হবে, এসে জানাল, তার চাচা নাকি রাজাকারদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। আর খানসেনাদের সঙ্গে গিয়ে বাড়ি-বাড়ি লোক তুলছে। জিজ্ঞেস করলাম, তুই কী করতে চাস? বলল, স্যার, এ তো দেশদ্রোহিতার কাজ হচ্ছে, আপনি হুকুম দিলে তাকে যথাযগ্য শাস্তি দেব। আমি মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, যা, তাই কর। আশ্চর্য, ছেলেটা শেষ পর্যন্ত দেশদ্রোহিতার প্রাপ্য শাস্তিই দিয়েছিল তার চাচাকে।’

আশ্চর্য আমরাও। এসব ঘটনা হয়তো কোনোদিন লেখাই হয়নি কোনো বইয়ে। জানার বাইরেও কত ছোটখাটো কথা লুকিয়ে থাকে, তা সমীরবাবুর কাছে না এলে জানাও হত না। এসব আজ ইতিহাস। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অমূল্য দলিল। যাতে অংশ নিয়েছিল ওই তরতাজা ছেলেটাও, নিজের রাজাকার চাচাকে হত্যা করে। সেও কি মুক্তিযোদ্ধা নয়?

মুক্তিযোদ্ধা তো সমীর মিত্রও! অন্তত তিনি নিজেকে তাই-ই বলতে ভালোবাসেন। যতই বিএসএফের হয়ে যুদ্ধে অংশ নিন না কেন, আদতে তো বাঙালি! আর, বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদান ভুলে যাওয়ার নয়। বাংলাদেশও তাঁকে আপন করে নিয়েছে সেই পরিচয়েই। ঢাকায় গিয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধারই সম্মান পান তিনি।

আর সেই মুক্তিযোদ্ধার সামনে বসে রয়েছি আমরা। খোদ কলকাতায়, ডিসেম্বরের বিকেলে। হ্যান্ডশেক করার সময়, তাঁর হাতের পাঞ্জার কাছে ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে আমার হাত। সত্যিই তো তাই! যে হাত একসময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বন্দুক তুলে নিয়েছিল, তার পাশে কি এই কলম-ছোঁয়া আঙুলগুলো মানায়! বরং ইতিহাস ছুঁয়ে আসা গেল এই সুবাদে।

আটচল্লিশ বছর পর, আমিও কি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের লিপিকার হয়ে গেলাম না?