এশিয়ান গেমসে ভারতের প্রথম স্বর্ণপদকজয়ী শচীন নাগ, পরবর্তীতে ডাক পাননি দেশের আয়োজনেই

১৯৫১ সাল। স্বাধীনতা এসেছে মাত্র ৪ বছর হয়েছে তখন। লস এঞ্জেলস-বার্লিন-লন্ডন অলিম্পিকে হকিতে পরপর সোনা জেতার সুবাদে, একটু একটু করে উঠে দাঁড়ানোর লড়াই চালাচ্ছে একটা জাতি। অনেকেই হয়তো একথা খুব একটা বলেন না, তবু এই আধুনিক ভারতের উত্থানের একটা বড় মার্গ রচনা করে দিয়েছিল পঞ্চাশের দশকের ভারতীয় ক্রীড়া সাফল্য। সারাবিশ্বের কাছে একটু একটু করে মাথা তুলল সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটা দেশ। এই ১৯৫১ সালে প্রথম এশিয়ান গেমসের আসর বসল দিল্লিতে। আর এই উদ্বোধনী এশিয়ান গেমসেই ভারতের হয়ে প্রথম স্বর্ণপদক নিয়ে এসেছিলেন এক বাঙালি। আজ নাম শুনলে অনেকেই হয়তো একটু চমকে উঠবেন। তিনি শচীন। তেন্ডুলকর নন। নাগ। কিংবদন্তি সাঁতারু শচীন নাগ। ভারতীয় ক্রীড়া ইতিহাসের এশিয়ান গেমসে প্রথম সোনা এনে দেওয়া ভারতীয় এই বাঙালিই।

বেনারস। কাশী বিশ্বনাথ মন্দির আর দশাশ্বমেধ ঘাটের রোমাঞ্চের মাঝেই এই বেনারস বিখ্যাত তার জনবৈচিত্র্যের জন্য। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এই শহরে স্বাধীনতার আগে থেকেই বাস বহু বাঙালি পরিবারের। এমনই এক বাঙালি পরিবারে ১৯২০-তে জন্ম শচীন নাগের। খুব ছোটো থেকেই সাঁতার তাঁর দিনলিপিতে ঢুকে গিয়েছিল অদ্ভুতভাবে। মাত্র ১০ বছর বয়সেই মজার ছলে পুলিশের হাত থেকে পালাতে গঙ্গায় ঝাঁপ দিত ছোট্ট শচীন। তারপর দুই নৌকোর মাঝে নিজেকে আড়াল করার জন্য অদ্ভুতভাবে সে নিজেকে নিয়ে যেত জলের তলায়। বেনারসে গঙ্গার কাছাকাছি বাড়ি হওয়া বন্ধুদের সঙ্গে বাজি নিয়েও ডুবসাঁতার দিত সে। সে সময়ে গঙ্গায় সাঁতার প্রতিযোগিতা ছিল খুব জনপ্রিয়। শুধু বেনারস না আমাদের বাংলাতেও বহুল চল ছিল এই গঙ্গাবক্ষে সাঁতার প্রতিযোগিতার। এমনই এক প্রতিযোগিতায় মাত্র ১২ বছর বয়সে অদ্ভুতভাবেই নাম দেন শচীন। পেশাদার সাঁতারুদের হারিয়ে তৃতীয় হয়ে চমকে দেন সকলকে। এই ছিল শুরু। নিজের আত্মজীবনীতে এই সাঁতার প্রতিযোগিতাকেই কেরিয়ারের উত্থানের ফলক হিসেবে দেখেছেন তিনি। 

১৯৩০-৩৬ সাল। টানা ৬ বছর নানা ছোটো-বড়ো সাঁতার প্রতিযোগিতায় নাম দিয়ে একের পর এক পদক জিততে থাকেন শচীন। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই শচীন হয়ে ওঠেন আক্ষরিক অর্থেই পেশাদার সাঁতারু। এরপরই শচীন পাড়ি দেন কলকাতায়। তাঁর কেরিয়ারে সাফল্যের এক বড়ো দরজা খুলে দিল শহর কলকাতা। সে সময়ে বাংলা ছিল জাতীয় স্তরে সাঁতারের আঁতুড়ঘর। কলকাতায় এসে তিনি বিখ্যাত হাটখোলা ক্লাবে শুরু করেন ট্রেনিং। বেঙ্গল স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপে দুই দুঁদে সাঁতারু মদন সিনহা ও রাজারাম সাহুকে হারিয়ে তিনি চ্যাম্পিয়ন হন। ১০০ মিটার ও ৪০০ মিটার পেশাদার ফ্রি-স্টাইলে এই ছিল শচীন নাগের প্রথম পদক। কিন্তু ফ্রি-স্টাইল সাঁতারের পাশাপাশি ওয়াটার পোলোতেও নিজের খেলার ধার বাড়াতে শুরু করেন শচীন। সেই সময়ে দিলীপ মিত্র ও দুর্গা দাস ছিলেন ভারতীয় সাঁতারের দুই স্বর্ণোজ্বল নাম। ১৯৪৮ লন্ডন অলিম্পিকে ভারতের প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি ১ মিনিট ৪ সেকেন্ডে ১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলের জাতীয় রেকর্ডের মালিক ও ছিলেন এই দিলীপ মিত্র। কিন্তু শচীন নাগ যেন কলকাতায় এলেন, দেখলেন আর জয় করলেন। তিনি দিলীপ মিত্রের ১০০ মিটারের জাতীয় রেকর্ড ভেঙে তিনি ভবানীপুরে মাত্র ১ মিনিট ২.২৫ সেকেন্ডে গড়লেন নয়া রেকর্ড, যা অটুট ছিল ৩১ বছর...  

১৯৪৮ লন্ডন অলিম্পিকে ১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করার পাশাপাশি, তিনি লন্ডন ও হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে ছিলেন ভারতের জাতীয় ওয়াটার পোলো দলের সদস্যও। ফ্রি-স্টাইল শর্ট ও লং ডিসট্যান্স সুইমিং-এর পাশাপাশি ওয়াটার পোলোতেও দেশের প্রতিনিধিত্ব করার মতো কৃতিত্ব সত্যিই বিরল। শুধু প্রতিনিধিত্বই না, ১৯৪৮ অলিম্পিকে ভারত ওয়াটার পোলোতে ৭-৪ হারায় চিলিকে এবং সেই ম্যাচে ভারতের হয়ে ৪টি গোল করেছিলেন শচীন নাগ।

আরও পড়ুন
মহামেডানের হয়ে ময়দান কাঁপালেন ‘ফুটবলার’ সৌরভ, নাস্তানাবুদ ইস্টবেঙ্গলও

শচীন নাগের কেরিয়ারের শ্রেষ্ঠ অধ্যায় ছিল ১৯৫১ এশিয়ান গেমস। দিল্লিতে ১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে সোনা জিতলেন তিনি। প্রথম ভারতীয় হিসেবে এশিয়া শ্রেষ্ঠ হয়ে তিনি সমাদর পেলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর কাছ থেকে। স্টেডিয়ামে বসে শচীনের সুইমিং দেখে মুগ্ধ হন পণ্ডিত নেহেরু। এছাড়াও ঐ একই এশিয়ান গেমসে ৪*১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে ব্রোঞ্জ ও জেতেন তিনি।  

আরও পড়ুন
প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে ওয়ার্ল্ড স্কিলে পদক জিতলেন শ্বেতা

তবু স্বীকৃতি কি সত্যিই পেলেন শচীন নাগ? ১৯৮২ সালে ভারতে ফের এশিয়ান গেমস আয়োজনের সময়ে আমন্ত্রণপত্রটুকু যায়নি এই কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদের কাছে। অথচ ভাবতে অবাক লাগে, এশিয়ান গেমস ভিলেজ সিরি ফোর্টে একটি ব্লকের নামাঙ্কন হয়েছিল এই স্বর্ণজয়ী বাঙালির নামে। 

আরও পড়ুন
ক্রিকেট, ফুটবল, সাঁতার, টেনিস – রবীন্দ্রনাথের উৎসাহ ছিল সবেতেই

তবু থেমে যাননি তিনি। ১৯৮৭ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে তিনি আরতি সাহা, নাফিসা আলির মতো সাঁতারের এক নতুন প্রজন্মকে তৈরি করে দিয়ে যান। ১৯৮৪ সালের ‘কোনি’ চলচ্চিত্রেও দেখা গিয়েছিল তাঁকে...

স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের বুকে, এশিয়ার শ্রেষ্ঠ সাঁতারু হিসেবে দেশকে সোনা এনে দিচ্ছেন এক বাঙালি - সেই নীল জলে অজস্র ভেসে যাওয়া ইতিহাসের মাঝে, আজ সত্তর বছর পরে এ-গল্পও কি এক রূপকথা হয়ে থমকে দাঁড়াবে না?

Powered by Froala Editor