ত্রিভুবন— তিরভুবন— মোনিকা স্টোর্স

ইলাহাবাদের পুরানা কাটরায় রেণু মাসি— বড়োমাসির বাড়ির সামনে— ৮৫৩/৭৩২ ঠিকানার সেই দোতলা বাড়ি, যার দোতলায় একটি মাত্র খাপরার— খোলার চালের পাকা ঘর, ‘পাকা’ বা ‘পাক্কা মকান’ অর্থে তার চারপাশের দেওয়াল ইট-সিমেন্টের। কিন্তু মাথার ওপর খোলা— মাটির— পোড়া মাটির লম্বাটে গেলাস বা গ্লাস আধখানা করলে, তা থেকেই তো খাপরা। বাংলায় বলে খোলা— খোলা চালের বাড়ি— টালি খোলার বাড়ি। এই যে গল্লি, তথ্য গল্লি— গলি আর গলি— ‘পাতলি গল্লি’, পাশিয়ানা, আহির পল্লিতে যাওয়ার জন্য পেরতে হয় ‘পরেট’— তৃণহীন, ন্যাড়ামুড়ো মাঠ, সেখানে খোঁটা বা খুঁটিতে বাঁধা থাকে গরু— গাই গরু, মাছু, মোষ। লাখনোয়া বা লখনোয়া ধোবি— লক্ষ্মণ ধোপা থাকে এখানেই। তার আছে একটি নয়, দুটি পোষা— পালতু গদাহা— পোষা গাধা। লাখনোয়া বা লখনোয়া হাফ প্যান্ট— তাকে হিন্দিবলয়ে ‘চাঢঢি’ বলে, অবশ্যই ইলাহাবাদেও। হাফ প্যান্ট— আন্ডারপ্যান্ট— সবই ‘চাঢঢি’। লখনোয়া বা লাখনোয়ার ডাঢ়ি-উরি, মৃদু মোচ— গোঁফ, দাড়ি সেভাবে গজায়ই না। লখনোয়া সাদা চাঢঢি আর সাদা হাফ শার্ট পরে শীতে। তেমন লম্বা নয় মোটেই। তার মাথায় ঘাড় পর্যন্ত শুয়োরের কুচি— শুয়োরের লোম যেন। এমন সিধে, কালো, সোজা সোজা চুল, অনেকটা যেমন মঙ্গোলয়েড ফিচারে হয়ে থাকে। এই গলিতেই চানকুর চায় কা দুকান। সেখানে সকাল থেকেই চায় কা ইন্তেজাম— চায়ের আয়োজন। দশ নয়া পয়সা দামের গুলাব ছাপ চায় কি পাতি— লাল ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর হলদে— হলুদ— প্রস্ফুটিত ফুটে ওঠা গোলাপ— গুলাব। চায়পাত্তির প্যাকেট— যার মধ্যে যা আছে, তার গায়ে লেখা কোম্পানির নাম— সেই কোম্পানির নাম ‘লিপটন’। সেটা ১৯৭১-৭২ সাল। দশ নয়া পয়সা দিলে এক প্যাকেট চায়কে পাত্তি। অবশ্যই গুঁড়ো চা, সেই এক প্যাকেট চায়ে অনায়াসে চার কাপ চা হয়ে থাকে। পাঁচ কাপও। পুরানা কাটরায় ‘ব্রাইটো’ নামে কাপড় ধোলাইখানা— ধোবিখানা বা লন্ড্রি আছে। সেখানে অর্ডিনারি, আর্জেন্ট, সেমি আর্জেন্ট— এইভাবে কাপড় ধোয়ার, কাচার, ইস্ত্রি করার সময়সীমা— দিন ঠিক হয়। আর্জেন্ট একদিনে, সেই কাচানোর রেট বেশি, সেমি আর্জেন্ট তিন দিনে, আর অর্ডিনারি পাঁচ থেকে সাত দিনে। সত্তর দশকে বালির গোস্বামী পাড়া রোডের ওপর সত্যনারায়ণ লন্ড্রি, সেই দোকানেও অর্ডিনারি, সেমি আর্জেন্ট, আর্জেন্ট। অর্ডিনারি শার্ট কাচানো পঁচিশ নয়া পয়সা। সেমি আর্জেন্ট চল্লিশ নয়া পয়সা। আর্জেন্ট— আট আনা— পঞ্চাশ নয়া পয়সা। সত্যনারায়ণ লন্ড্রির মালিক একটু লম্বাই— পায়জামা, পাঞ্জাবি অথবা পায়জামা-ফুলশার্ট সেই ফুলশার্ট, ছিটের লং ক্লথ নয়তো আর কিছু। মার্কিন নয়। দাড়ি-গোঁফ কামানো, গোল মুখ। মাথার ব্যাকব্রাশ করা চুলে বাবরির ছোঁয়া। ঘাড় পর্যন্ত প্রায় কেই কেশনাহন। জামার হাতা তিনি প্রায় কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রাখতেন। গরমের দিনে জামা খুলে ফেলে গেঞ্জি গায়ে দোকানদারি করতেন। তখন সব জায়গাতেই প্রায় কাপড় কাচার লন্ড্রি। কলকাতায় চিনারা চালান লন্ড্রি। কালীঘাটে চিনা লন্ড্রি ছিল, তার নামও ব্রাইটো। স্কার্ট পরা এক প্রায়-পৃথুলা চিনা নারী সেই দোকান চালান। তাঁর সঙ্গে কাপড় কাচা, কাপড়— প্যান্ট-শার্ট নামানো, ধরার জন্য অন্য এক জন। মহিলাটির সহজীবনের মানুষ— তিনিও তো লন্ড্রির কাজই করেন। তাঁদের দুটি সন্তান— নাকুটপুটু— নেক চেপটু, খুব ভালো লাগে তাদের দেখতে। হলদে-ফরসা লাল লাল গাল, যেন পুতুল-পুতুল। ‘নাকুটপুটু’ বা ‘নাক চেপটু’ তাদের নাম নয়। এই নামকরণ করা আমারই, নিজের। কলকাতায় তখন বেশ কয়েকটি চিনা লন্ড্রি— কাপড় ধোলাইয়ের দোকান। সেখানে নাকি মেশিনে ড্রাইওয়াশ হয়, পেট্রোল ওয়াশ। সত্যি, মিথ্যে জানি না। বলতে পারব না। কিন্তু প্রচার তো এমনই, বলেও অনেকে। চিনা লন্ড্রিতে এক শীত থেকে অন্য শীত পর্যন্ত প্রায়, কোট, গভরম প্যান্ট, স্যুট— শাল, গরম চাদর, জামেওয়ালা, পাশমিনা, দোশালা— সবই রেখে দেন বাঙালি-অবাঙালি, বড়োলোক ও মধ্যবিত্ত। অকারণে নিজেদের আলমারি, ওয়ার্ডরোবে কে ভর্তি করে রাখতে চায়, সেখানে জমা না করে চিনে বাড়ির লন্ড্রিতে রাখা। ভালো থাকে গরম জামা-কাপড়, আরশোলা, পোকায় কাটে না। তখন ‘শান্তিপুর শাল রিপেয়ারিং’-এর বেশ কয়েকটি শাখা কলকাতায়। চেতলাতে এই যে ‘শান্তিপুর শাল রিপেয়ারিং’, তার একটি শাখা ছিল, আমার বাবা অমরনাথ রায় সেখানে শাল, গরম চাদর, শোয়েটার কাচতে দিতেন, হাওড়া জেলার বালি থেকে এসে। চাদরকে ‘গায়ের কাপড়’ বলার দেওয়াজ ছিল তখন। শাড়ি-ধুতিদের কাপড়। তখন ছয়ের দশকে— ষাটের দশকে শাল কাচাতে পাঁচ টাকা— শান্তিপুর শাল রিপেয়ারিং-এ। গরম কোট— অলেস্টার, ব্লেজার ইত্যাদি সাত থেকে দশ টাকায়। দোকানের নাম শান্তিপুর শাল রিপেয়ারিং, তার শাখা দক্ষিণ কলকাতার ঊষার বাসস্টপেও। সেখানে জামা-কাপড় কাচা-কাচি ছাড়াও, পোকায় কাটা, নয়তো ছিঁড়ে যাওয়া শাল রিফু করা হয়। যাঁরা রিফু করেন— আমি নামজাফা রিফুকর বা রিফুকরদের কথা বলছি, তাঁরা মূলত ইসলাম ধর্মের মানুষ। কি চমৎকার সূক্ষ্ম, শিল্পসম্মত তাঁদের হাতের কাজ। চোখে চশমা, মাথায় টুপি, হাতে পাখি সুচ আর সুতো। এঁদের বহুবার দেখেছি, নানাভাবে, নানা সূত্রে শাল, কোট, শালকরের দোকানে দোকানে। ইলাহাবাদের পুরানা কাটরায় ছয় আর সাতের দশকে ‘ব্রাইটো’ খুবই নামকরা লন্ড্রি। সিভিল লাইনস ও চওকেও শালকররা আছেন, লন্ড্রিও। তাঁদের রেট ‘ব্রাইটো’-র তুলনায় অনেকটাই বেশি। তবে তাঁদের— মানে সিভিল লাইনস ও চওকের ধুলাইখানা— ধোলাইখানা— ধোবিখানার রেট— কাপড় ধোলাই বা ধুলাইয়ের কাজ-খরচাপাতি বেশ অনেকটাই বেশি। পুরানা কাটরায় লখনোয়া বা লাখনোয়া ধোবি ধারিদার, রঙিন— চেককাটা রঙিন ‘চাঢঢি’ পরত তা আগেই বলেছি। কিন্তু ইলাহাবাদে ধারিদার— চেকচার রঙিন চাঢঢির খুবই চাহিদা ছিল। মানে বেশিরভাগ জনই পরতেন ডোয়াদার রঙিন চাঢঢি। লখনোয়া বা লাখনোয়া ধোবিকে এই মহল্লার প্রায় সবাই ‘মেহেরা’— মেহেরুল বা ‘মেহরুল’ বলে চিঢ়াত— খ্যাপাত। কোম্পানিবাগ বা কোম্পানি বাগানে বড়ো তালাও আছে। সেই তালাও— পুকুরে কাপড় কাচতে যেত লখনোয়া ধোবি, গদাহা— তার পোষা গাধার পিঠে মাল লাদাই করে। কোম্পানিবাগে পৌঁছেই লখন তার গদাহা— দুটো গাধাকেই ছেড়ে দেয়, ঘাস খাওয়ার জন্য। বেলা পর্যন্ত তার কাচাকাচি। ভোর ছটায়— কী শীত কী গ্রীষ্ম গদাহাদের পিঠে অপরিচ্ছন্ন কাপড় বোঁচকা বেঁধে নিয়ে যেত লখনোয়া। তারপর বেলা বারোটা-একটা পর্যন্ত কাচাকাচি। তারপর গাছের সঙ্গে— গাছে গাছে সেই পরিষ্কার করা কাপড়দের ঝুলিয়ে দেওয়া, শুকোনোর জন্য। পোড়া মাটির তৈরি লালচে, বড়ো গামলায় নীলের জল। সোডা-সাবানের জল। ‘রবিন ব্লু’-ই তখন ব্যবহার হয় কাপড়ে নীল দিতে, বিশেষ করে সাদা কাপড়ে, সাদা ধুতি-শাড়ি, সাদা পাঞ্জাবি, পায়জামায়। তখন তো বাজারে সিনথেটিক, ক্রিস্টাল যোগ নীলও আছে, রবিন ব্লু— প্যাকেট-নীল গুঁড়ো। ছোটো বড়ো প্যাকেটে ‘রবিন ব্লু’ পাওয়া যায়। বড়ো প্যাকেটের রবিন ব্লু সাধারণত বাড়ির দেওয়ালে চুনকাম করার সময় মেশানো হয় কালি চুনের সঙ্গে। বহু বছর বন্ধ নীল চাষ, ফলে বাজারে চৌকো চৌকো, ছোটো ছোটো ক্রিস্টাল শেপ নীল। তখন তো এলা মাটি আর কলিচুন— এটাই মূলত ঘর-বাড়ি রঙ করার মূল উপাদান। ডিসটেম্পার রঞের কথা অল্প, অল্প শোনা যাচ্ছে, আমি ছয়ের দশক বা ষাটের দশকের একেবারেই অন্তিম পর্বের কথা বলছি। তার পরে তো ডিসটেম্পার এসে গেল, প্লাস্টিক পেস্ট— ওয়াশেবল রঙ, ‘বার্জার’, ‘এশিয়ান পেইন্টস’— কত কত না রঙ কোম্পানি চারপাশে ধীরে ধীরে জেগে উঠল। ছয়ের দশকে অবশ্য রয়েছে ‘এশিয়ান পেইন্টস’, সঙ্গে ‘জনসন অ্যান্ড নিকলসন’। পার্কস্ট্রিটের ঠিক আগে আগে— দক্ষিণ কলকাতার রাসবিহারীর মোড় থেকে ধর্মতলার দিকে যেতে ‘টাটা সেন্টার’ আর ‘চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনাল’-এর বড়ো বড়ো দুটো হাইরাইজ, আকাশ খাবলানো মাল্টি স্টোরিড— বহুতল পেরিয়ে এলেই তখন পর পর দুদুটো বড়ো বড়ো হোর্ডিং— একটা জনসন অ্যান্ড নিকলসন নামে রঙ কোম্পানির অন্যটা ‘আমূল বাটার’— ‘আমূল মাখন’-এর। তো সে যাই হোক, লাখনোয়া বা লখনোয়া ধোবির ময়লা কাপড় চৌকো শানে আছাড় মেরে মেরে কাচা, ধোয়া কাপড় শুকানো— সবই তো এক ছন্দবন্ধ যাত্রা, যেমন হয়ে থাকে। এই পুরানা কাটরা বা পুরানা কটরা থেকে বেরিয়ে এসে বড়ো রাস্তার ওপর পড়লে ডান দিকে সামান্য গেলেই ‘মোনিকা স্টোর্স’। ‘মোনিকা স্টোর্স’ স্টেশনারি— খানিকটা শৌখিন স্টেশনারি বিক্রির দোকান। মেয়েদের নকল-গয়না, উপহার— গিফট দেওয়ার নানান আইটেম— ‘মুখে ভাত’— অন্নপ্রাসন, বিবাহ, জন্মদিন— সমস্ত অনুষ্ঠানেরই বেশ ভালো ভালো গিফট আইটেম এখানে আছে। ত্রিভুবন বা তিরভুবন এই মোনিকা স্টোর্সের মালিক। খুব শৌখিন— সর্বদা ফিটফাট, রইস আদমি— বড়োলোক বাড়ির ছেলে যেমন হয়। সর্বদা দুরন্ত— সাদা বেলবটম, সাদা জুতো, ফিতে বাঁধা শ্যু, চোখে কাক-কালো সানগ্লাস। ত্রিভুবনের ঠাকুর্দা মিশ্রাজি। ইউপি-র ব্রাহ্মণ তাঁরা। তিরভুবন তাঁর অতি আদরের নাতি। তিরভুবন বা ত্রিভুবনের এক ছোটো ভাই আছে। তার ঘাড় পর্যন্ত হিপি কাটিং চুল। শীতের দিনে কোট, বাহারি— রঙদার ফুল হাতা শোয়েটার, ভি বা গোলগলা। কোনো কোনোদিন হাইনেক। ত্রিভুবন বা তিরভুবনের দাড়ি, গোঁফ— সেও তো লখনোয়া বা লখনোয়া ধোবির স্টাইলে, খাপচা খাপচা— দু’চারটে। তাকেও অনেকে ‘মেহেরা’— মেহেরুল বলে অনেকে। কিন্তু সামনাসামনি বলতে একেবারেই সাহস পায় না। তরভুবনের এই যে মোনিকা স্টোর, তার ব্যাকগ্রাউন্ডের ‘মোনিকা’টি কে, তা অবশ্য জানা যায় না সেভাবে। অনেক অনেক রকম অনুমান আছে। কিন্তু সেই আন্দাজ ঢিল মেলা না। তিরভুবনের ‘দাউ’— দাদ্দা— ঠাকুর্দা মিশ্রাজি— অসম্ভব ক্ষমতাবান মানুষ। উত্তরপ্রদেশের জাতীয় কংগ্রেসি রাজনীতিতে তখন পণ্ডিত-ব্রাহ্মণদের খুব প্রতাপ। সাতের দশকে— সত্তর দশকে গোটা দেশ— সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়েই কংগ্রেস আর কংগ্রেস। পরের পর কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী সাপ্লাই দেওয়া ইউপি— উত্তরপ্রদেশ থেকে। কমলাপতি ত্রিপাঠী তখন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর এক পুত্রের নাম লোকপতি ত্রিপাঠী। কমলাপতি ত্রিপাঠীজির দাড়ি-গোঁফ কামানো গোল মুখ। কপালে গোলা আর সিঁদুর হলুদের টিকা— টিপ। ধুতি-পাঞ্জাবি। উত্তর প্রদেশের রাজনীতিতে তখন পণ্ডিত— ব্রাহ্মণ লবি খুবই স্ট্রং— পোক্ত। কায়স্থ লবি, ঠাকুর লবিও আছে। ব্রাহ্মণ বলতে মিশ্রা, চতুর্বেদী— চৌবে, দ্বিবেদী— দুবে, শুক্লা— শুকুল, এরকম সব পদবি। কায়স্থ বলতে খারে, শ্রীবাস্তব, সাকসেনা, ঠাকুর— রাজপুত শুধু নয় ইউপির ছত্রী বলতে সিং। জাতপাত, ছুয়া-ছুত— ছোটোজাত, বড়োজাত, ইত্যাদির ব্যাপার তখন খুব ইউপিতে— এখনও। তিরভুবন— ত্রিভুবন আবার একইসঙ্গে মিশ্রা কোম্পানির মিশ্রাজির বৌ— অঞ্জলি, সবিতাদের মায়ের প্রেমিক। পাশাপাশি অঞ্জলির সঙ্গেও তার খানিক খানিক রসের সম্পর্ক। তবে অঞ্জলি-সবিতাদের মায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অতি গাঢ়। মুখে ভৌ, জাই, ভাবি ইত্যাদি বললেও সেই সম্পর্কের নিবিড় টান অনেক অনেক গহেরা— গভীর। এই খবর— সংবাদ ইলাহাবাদের পুরানা কাটরার প্রায় সবাই জানে। রেণুমাসির মেজো ছেলে দিলীপ ভট্টাচার্য— ডাক নামে বেডু, তার বন্ধুরা ইন্দে সাকসেনা— ইন্দের পুরো নাম ইন্দিনর। ইন্দে সাকসেনা ছাড়াও তিরভুবন— ত্রিভুবন, রমেশ, এরা সবাই তার বন্ধু। লাল্লন গুপ্তা— বাবিয়া। কালোয়ারদের পদবি জয়সোয়াল। তিরভুবনের মোনিকা স্টোর্স-এর উল্টোদিকে ‘জয়সোয়াল ইলেকট্রিক’। এই দোকানটির মালিক হুবলাল জয়সোয়াল। হুবলাল ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, নাকের নিচে মোটা গোঁফ। তেমন লম্বা নয় কিন্তু গঠিলা বদন। গঠিলা বদন অর্থে পেশীবহুল চেহারা। টেরিকটের ফুলপ্যান্ট, সেই সঙ্গে সঙ্গে টেরিকটের বুশশার্ট, রঙিন। হাতে, বাঁ হাতে স্টিল ব্যান্ডের ঘড়ি। সেই ঘড়ি— ভারি জনদার ঘড়ি ঝুল ঝুল ঝুল ঝুল করে ঝুলে পড়ছে কবজির ওপর। হুবলাল জয়সোয়ালের ‘জয়সোয়াল ইলেকট্রিক’— বড়ো রাস্তা থেকে সামান্য উঁচুতে উঠে, তারপর। দোকানের সাজসজ্জা— অন্তত বহিরঙ্গে তেমন কিছু নয়। হুবলালের একমাত্র সন্তান— পুত্র সন্তান বব্বু। সেও বসে দোকানে। ইলেকট্রিকের নানা সাজ-সরঞ্জাম তো ছিলই এই দোকানে, সেইসঙ্গে নানা ধরনের টেবল ল্যাম্প, ল্যাম্পশেড। আগেও লিখেছি হয়তো ‘জয়সোয়াল ইলেকট্রিক’-এ নানাধরনের টেবল-বাতি-টেবল ল্যাম্প, ল্যাম্পশেড ভালো-ঢাকনি পাওয়া যায়। আলিগড় থেকে আনানো টেবল বাতি— টেবল ল্যাম্প অনেকটা যেন সাপের ফণা— কালো কুলোপানা চক্কর তার, তার ডিজাইনেই টেবল ল্যাম্পের বিশেষ হয়ে ওঠা। দূর থেকে অতি চমৎকার দেখতে। সুন্দর— অতিসুন্দর, মনমোহক, অন্তত আমার চোখে তো তেমনই মনে হয়েছে বার বার— বার বার দেখে, মুগ্ধতা আর শেষ হয় না, দেখতেই থাকি। এছাড়াও টেবল ল্যাম্প, ল্যাম্পশেডের ডিজাইনে সুকুমার রায়ের হাট্টিমা টিমটিম প্রায়ই, কোনো খেলনা-মুরত— খিলোনা মূর্তি। কী করে যে সুকুমার রায় উত্তরপ্রদেশের ইলাহাবাদেও ছড়িয়ে পড়লেন, জানি না। নাকি সবটাই আমার মনের ভুল, দেখার ত্রুটি? বলতে পারব না।

Powered by Froala Editor