একাধিক প্রজন্মকে পদার্থবিদ্যার পাঠ দিয়ে ‘পদ্মশ্রী’ এইচ. সি. ভার্মা

তেলমাখা বাঁশে বাঁদরের ওঠা-নামা যেমন কেশবচন্দ্র নাগের ট্রেডমার্ক, তেমনই পুলিতে চেপে বাঁদরের দৌরাত্ম্যের গাণিতিক সমস্যার সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছি তাঁর সৌজন্যেই। হরিশ চন্দ্র ভার্মা। অবশ্য এইচ. সি. ভার্মা (H. C. Verma) নামেই তিনি বেশি পরিচিত বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের কাছে। দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়াকালীন তাঁর লেখা ‘কনসেপ্ট অফ ফিজিক্স’ বইটির সঙ্গে আলাপ হয়নি, বিজ্ঞান বিভাগে এমন ছাত্র পাওয়াই দুষ্কর। এবার ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান পদ্মশ্রীতে (Padmashree Award) ভূষিত হলেন খ্যাতনামা পদার্থবিদ, শিক্ষাবিদ এবং গবেষক।

১৯৫২ সালে বিহারের দ্বারভাঙা জেলার জন্ম হরিশ চন্দ্র ভার্মার। তবে বাবার কর্মসূত্রে তাঁর ছাত্রজীবনের অধিকাংশটাই কেটেছে পাটনাতে। বাবা গণেশ প্রসাদ ভার্মা পেশায় নিজেও ছিলেন শিক্ষক। তাঁর কাছেই গণিতে হাতেখড়ি হয় হরিশ চন্দ্রের। তবে স্কুলজীবন ততটাও মসৃণ ছিল না তাঁর। এমনকি সেসময় বিজ্ঞানের বিষয়ে লাল কালির দাগ পড়েছে রিপোর্ট কার্ডে। কিন্তু গতে বাঁধা শিক্ষা, পরীক্ষায় খাতায় নম্বরের আধিক্য কোনোদিনই ভাবায়নি হরিশ চন্দ্রকে। বরং, ভাবিয়েছিল তত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগ। বিজ্ঞানের মূলমন্ত্র তো সেটাই। বলাই বাহুল্য, স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।

পাটনা কলেজ থেকে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা করার পর সুযোগ আসে কানপুর আইআইটিতে পঠনপাঠনের। সেখান থেকেই পদার্থবিদ্যায় প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন। তারপর ঢুকে পড়া গবেষণা এবং অধ্যাপনার জগতে। ১৯৮০ সাল থেকে দীর্ঘ ১৫ বছর তিনি অধ্যাপনা করেছেন পাটনা কলেজে। এরপর ১৯৯৪ সালে ফিরে যাওয়া সেই কানপুর আইআইটিতেই। তাছাড়াও একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপকের ভূমিকাতেও দেখা গেছে তাঁকে। 

প্রায় চার দশকের গবেষকজীবনে ন্যানো ফ্যাব্রিকেশন, গ্রাফাইটের চুম্বকীয় ক্ষেত্র, শঙ্কর ধাতু সম্পর্কিত একাধিক উল্লেখযোগ্য গবেষণায় দিশা দেখিয়েছেন হরিশ চন্দ্র ভার্মা। বিভিন্ন প্রথম সারির আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ১৩৯টি গবেষণাপত্র। যদিও তিনি সর্বজনীন হয়ে উঠেছেন তাঁর লেখা বইগুলির সৌজন্যেই। দ্বাদশ শ্রেণির জন্য লেখা ‘কনসেপ্ট অফ ফিজিক্স’-এর দুটি খণ্ড ভারতের কোনো বোর্ডের অনুমোদন না পেলেও, বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের কাছে তা অমৃত-সমই। বিজ্ঞানের দুরূহ ভাষা সরিয়ে রেখে জটিল তত্ত্বের সহজবোধ্য উপস্থাপনার ক্ষেত্রে এখনও যে গ্রন্থের বিকল্প নেই কোনো। তাছাড়াও পদার্থবিদ্যার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের একাধিক বইয়ের রচয়িতা তিনি।

আরও পড়ুন
পদার্থবিজ্ঞানের পরীক্ষামূলক সমাধান খুঁজতে হেলিকপ্টার ভাড়া করলেন ব্যক্তি!

তবে এখানেই শেষ নয়। পদার্থবিদই বলা হোক কি শিক্ষাবিদ— এর বাইরেও এক বর্ণময় চরিত্র এইচ. সি. ভার্মা। আইআইটিতে অধ্যাপনা করার পাশাপাশি স্কুলের কচিকাচাদেরও নিয়মিত পাঠদান করে এসেছেন হরিশচন্দ্র। দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে শিক্ষাদানের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘শিক্ষা সোপান’ নামের অলাভজনক সংস্থা। ২০১৭ সালে অধ্যাপকজীবন থেকে অবসর গ্রহণের পর এই সংস্থাই এখন তাঁর ধ্যানজ্ঞান। নিজে তো বটেই, তাঁর দৌলতে খ্যাতনামা শিক্ষাবিদরাও নিয়মিত হাজির হন এই প্রতিষ্ঠানে। তাছাড়াও কম খরচে পদার্থবিদ্যার তত্ত্বের পরীক্ষামূলক উদাহরণের প্রায় ৩০০-র বেশি পন্থার উদ্ভাবক তিনি। যা ছাত্রদের সামনে উপস্থাপন করা সম্ভব ক্লাসের চার দেওয়ালের মধ্যেই। 

আরও পড়ুন
পাঁচেই শেষ নয়, পদার্থের নতুন দশার হদিশ পেলেন গবেষকরা

এর আগে পদার্থবিদ্যার জগতে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ২০১৭ সালে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ শিক্ষা পুরস্কার পেয়েছিলেন হরিশ চন্দ্র। এবার আরও একটি পালক জুড়ল তাঁর মুকুটে। আসলে পদার্থবিদ্যাকে শিক্ষার্থীমহলে জনপ্রিয় করে তোলায় তাঁর কৃতিত্বকে অস্বীকার করার জায়গাই যে নেই কোনো… 

আরও পড়ুন
ব্ল্যাকহোলের গ্রাসে নক্ষত্রও! খুলল পদার্থবিদ্যার নতুন দিগন্ত

Powered by Froala Editor