স্টিফেন হকিং-এর কাছে তিনি ‘গ্রেটেস্ট’, বিস্মৃতির অতলে বাঙালি পদার্থবিদ জে এন ইসলাম

সূর্যের চারপাশে ক্রমশ আবর্তনরত পৃথিবী। তবে কেবলমাত্র সূর্যের আকর্ষণ বল নয়, সেইসঙ্গে অন্যান্য গ্রহগুলির মহাকর্ষীয় বল সমানভাবেই প্রভাবিত করে নীলগ্রহকে। এখন যদি সৌরজগতের সব কটি গ্রহ একই সরলরেখায় চলে আসে, তবে কি নিজের কক্ষপথ থেকে ছিটকে যাবে পৃথিবী? ২০০১ সালের কথা। এমনই এক প্রশ্নে রীতিমতো তোলপাড় পড়ে গিয়েছিল গোটা বিশ্বজুড়ে। উঠে এসেছিল পৃথিবীর ধ্বংসের একাধিক তত্ত্ব। সেই বিতর্কের মধ্যে দাঁড়িয়েই গণিতের ভাষায় জবাব দিয়েছিলেন এক বঙ্গসন্তান। গাণিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন আশঙ্কার সেই সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।

জামাল নজরুল ইসলাম। বাংলাদেশের কিংবদন্তি পদার্থবিদ ও মহাকাশবিদই সেদিন সমাধান দিয়েছিলেন সেই জটিল ধাঁধাঁ এবং গুজবের। বাংলাদেশ তো বটেই, গোটা এশিয়ার সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ ও গবেষকদের তালিকায় প্রথম সারিতেই রয়েছে তাঁর নাম। এমনকি তাঁর লেখা গ্রন্থ পাঠ্য হিসাবে পড়ানো হয় অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড, ক্যালটেকের মতো বিশ্বমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে। অথচ, ভারত-বাংলাদেশ তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে অনালোচিতই রয়ে গেছেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব। 

বাংলাদেশের ঝিনাইদহে জন্ম হলেও, কিংবদন্তি পদার্থবিদের কৈশোর কেটেছে কলকাতাতেই। তিলোত্তমার স্কুলেই হাতেখড়ি তাঁর। দেশভাগের পর চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে পড়াশোনা করার পর আবার ফিরেছিলেন কলকাতায়। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে গণিতে স্নাতক হন জেএন ইসলাম। তারপর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা। বিষয় সেই গণিতই। পদার্থবিদ্যার জগতে পা দেওয়া তারও পরে। প্রয়োগিক গণিতে পিএইচডি করার সূত্রে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে বাঙালি গবেষকের। ১৯৬৪ সালে পিএইচডি করার পর, কেমব্রিজ থেকেই ডক্টর অফ সায়েন্স ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। আর সেসময় তাঁর সহপাঠীর আসনে ছিলেন আরেক কিংবদন্তি বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। শিক্ষক হিসাবে পেয়েছেন ফ্রিম্যান ডাইসন, রিচার্ড ফেইনম্যানের মতো ব্যক্তিত্বদের।

১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় স্টিফেন হকিং-এর কালজয়ী গ্রন্থ ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’। গোটা পৃথিবীতে সব মিলিয়ে বিক্রি হয় এই বইটির এক কোটিরও বেশি কপি। মূলত ব্ল্যাক হোল, ওয়ার্ম হোল, কসমিক রেডিয়েশন, প্যারালাল ইউনিভার্স এবং আপেক্ষিকতাবাদের বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছিলেন স্টিফেন হকিং। অথচ, এর ঠিক বছর পাঁচেক আগেই প্রকাশিত হয়েছিল জামাল নজরুল ইসলামের বই ‘দ্য ফেট অফ দ্য ইউনিভার্স’। এই বইটির আলোচ্য বিষয় ছিল একই। সহজতর ব্যাখ্যা এবং গাণিতিক পদ্ধতির জন্য পরবর্তীতে এই বইটিকেই পাঠ্যপুস্তক হিসাবে স্বীকৃতিও দেয় একাধিক প্রথম সারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অনূদিত হয় জার্মান, ফরাসি, জাপানি-সহ একাধিক ভাষায়। কিন্তু, আশ্চর্যের বিষয় হল, এমন একটি গ্রন্থের পরিচয় সীমাবদ্ধ থেকে যায় কেবলমাত্র হাতে গোনা বিজ্ঞানমনস্ক কিছু ব্যক্তিদের মধ্যেই। এমনকি কিংবদন্তি বাঙালি গবেষকের প্রসঙ্গে স্টিফেন হকিংও মন্তব্য করেছিলেন ‘He is only the greatest.’ 

আরও পড়ুন
গবেষণার সঙ্গে নারীশিক্ষার প্রসারে লড়াই, ফ্রান্সের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি পেলেন ভারতীয় পদার্থবিদ

তা সত্ত্বেও কেন প্রচারের আড়ালে থেকে গেলেন এমন একজন কালজয়ী গবেষক এবং তাত্ত্বিক? ফিরে যাওয়া যাক, ‘দ্য ফেট অফ দ্য ইউনিভার্স’ গ্রন্থটির প্রকাশকালের সময়ে। ১৯৮৩ সালে এই গ্রন্থ প্রকাশ পাওয়ার ঠিক পরের বছরই জামাল নজরুল ইসলাম ফিরে আসেন বাংলাদেশে। দু’চোখে ছিল নিজের দেশের বিজ্ঞানের পরিকাঠামোকে সুদৃঢ় করে তোলার স্বপ্ন। সেই লক্ষ্য নিয়েই বৈদেশিক জীবন, গবেষণার অনুকূল পরিকাঠামো, অর্থ, প্রতিপত্তি ছেড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন নজরুল ইসলাম। বেতন মাত্র ৩ হাজার টাকা। ততদিনে তাঁর করায়ত্ত হয়েছে মেরিল্যান্ড, কেমব্রিজ, ক্যালটেক, কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনার অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই প্রায় একক প্রচেষ্টায় তিনি গড়ে তোলেন বাংলাদেশের রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথামেটিক্স অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্স। নিঃসন্দেহে লক্ষ্যভেদ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু কোথাও যেন আত্মবিসর্জন দিতে হয়েছিল ৩০ বছর ধরে গড়ে তোলা নিজের দাঁড়াবার জায়গাটাকেও। 

আরও পড়ুন
প্রয়াত অধ্যাপক মৃণালকান্তি দোয়ারী, একাদশ শ্রেণীতে পদার্থবিদ্যা চিনিয়েছিলেন যিনি

তবে তারপরেও থেমে থাকেনি গবেষণা। এরপরেও পদার্থবিদ্যার একাধিক প্রামাণ্য বই লিপিবদ্ধ করেছেন ডঃ নজরুল ইসলাম। তাঁর প্রকাশিত গবেষণাপত্রের সংখ্যাও শতাধিক। কিন্তু নিজের দেশেই অনালোচিত থেকে গেছেন তিনি। জীবদ্দশায় খোদ বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় তিনি জায়গা পেয়েছিলেন কেবলমাত্র একবার! ভারতেও তাঁকে নিয়ে আলোচনা হয়নি বললেই চলে। 

আরও পড়ুন
পৃথিবী কিংবা সূর্য জন্মায়নি তখনও, ৭০০ কোটি বছরের ‘বৃদ্ধ’ এই পদার্থ

২০১৩ সালের ১৬ মার্চ ৭৪ বছর বয়সে প্রয়াত হন কিংবদন্তি বাঙালি বিজ্ঞানী। তারপর অবশ্য খানিকটা হলেও দক্ষিণ এশিয়া ও এশিয়ার সংবাদমাধ্যমে চর্চিত হয়েছিলেন ডঃ নজরুল ইসলাম। কিন্তু তারও বেশ কয়েক বছর পেরিয়ে এসে আজ ক’জনই বা মনে রেখেছে এমন একজন ব্যক্তিত্বকে। শুধু বিজ্ঞানমনস্কতাই নয়, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণ বৈষম্য, পশ্চিমা শক্তির রাজনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদী অবস্থান আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে যেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। শিক্ষণীয়ও বটে… 

Powered by Froala Editor

More From Author See More