উপন্যাস প্রকাশের দায়িত্ব দিলেন দেবেশদা, শেষ হল না সে-লেখাও

সেসব নব্বই-এর দশকের কথা। আমরা যখন লেখালিখি করতে শুরু করি, সে এক ভারী অদ্ভুত সময়। সেই সময়টাতে খুব সুস্পষ্ট বিভাজন ছিল লিটল ম্যাগাজিন এবং প্রতিষ্ঠানের। মানে প্রতিষ্ঠান এবং ‘অপ্রতিষ্ঠান’। আনন্দবাজার গোষ্ঠী একমাত্র প্রতিষ্ঠান সেই যুগে। আর তার বিরুদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসাবে চিহ্নিত কিন্তু অনেকগুলো ‘অপ্রতিষ্ঠান’। এই দুই প্রতিষ্ঠান এবং অপ্রতিষ্ঠানের দু’জন অলিখিত মসিহা ছিলেন। একজন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অন্যজন দেবেশ রায়।

যখন আমরা লিখতে এলাম, আমাদের অগ্রজদের তৈরি করে দেওয়া কথাসাহিত্যের পাঠ্যতালিকায় দেবেশ রায় ছিল প্রথম নাম। তারপর একে একে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, অসীম রায়, উদয়ন ঘোষ, অমিতাভ দাশগুপ্ত, নবারুণ ভট্টাচার্য প্রমুখ। এমন একটি ধারণা যে, আমরা যদি এঁদের লেখা পড়ি এবং এঁদের লেখা নিয়ে আলোচনা করি, তাহলে আমরা ঠিকঠাক লেখালিখির পথে যাচ্ছি। এরকম একটা প্রতিস্পর্ধা থেকে তখন লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন চলত।

খুবই সুস্পষ্ট ছিল এই বিভাজন। যেন ক্লাসিকাল লিটারেচারের সঙ্গে বাজারমুখী তথাকথিত মেইনস্ট্রিমের দ্বিকোটিক বিভাজন। এই বিভাজন ভুল হোক বা ঠিক হোক, আমরা যারা লিটল ম্যাগাজিন করতাম, নিজেদের আদর্শগত জায়গা থেকে দেবেশ রায়কেই বেছেছিলাম এবং খুব মন দিয়ে দেবেশ রায়ের উপন্যাস, ছোটোগল্পগুলো পড়েছি।

সে-আমলে এক অদ্ভুত ব্যতিক্রমের জন্ম দিয়েছিল আজকাল পত্রিকা। ওরা একেকটা পুজোসংখ্যায় একটা অদ্ভুত সম্মিলন ঘটাত। দেবেশ রায় গোটা বছরে একটাই উপন্যাস লিখতেন। সেটা আজকালে। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ও তাই। একটা সময় গিয়ে আবুল বাশারেরও উপন্যাস বা বড়ো গল্প দেখেছি ওখানে ছাপা হতে। পাশাপাশি লিটল ম্যাগাজিনের যাঁরা তথাকথিত চিহ্নিত সাহিত্যিক, তেমন আরো অনেকেরই লেখা থাকত  আজকালের পুজোসংখ্যায়। তখন আজকালের পুজোসংখ্যা আমাদের কাছে লিটল ম্যাগাজিন বলে গণ্য হত।

দেবেশ রায়কে কাছাকাছি দেখার প্রথম সুযোগ হয়েছিল একটি লিটল ম্যাগাজিনের কর্মী হিসেবেই। সেই লিটল ম্যাগাজিন একটা সিরিজ শুরু করেছিল। ‘তরুণ লেখকদের প্রতি’। সেই সিরিজে তখন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, বিজন চৌধুরী, পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায় লিখে ফেলেছেন। সেই সময় দেবেশ রায়ের একটি মূল্যবান লেখা আমরা পেয়েছিলাম।

এইভাবেই যাতায়াতের সূত্রপাত। দেবেশদার আমন্ত্রণে তাঁর স্ত্রী কাকলি রায়ের কলাকুঞ্জের অনুষ্ঠানে থাকার বিরল স্মৃতি। রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর গায়কির সঙ্গে তুলনা করা হত রাজেশ্বরী দত্তের।

দেবেশ রায় যখন লিখতেন কিংবা কথা বলতেন, তখন যেন মেধাতান্ত্রিকভাবে গোটা বাঙালি জাতি উঠে আসত। গোটা ভারতও। এতটাই বড়ো ছিল তাঁর লেখার প্রেক্ষিত। তাঁর যে বিখ্যাত উপন্যাস, যেটা আমার পড়া সবথেকে বড়ো এপিক বাংলা সাহিত্যে, তা হল ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’। পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছিল, দেবেশদা কোথাও গিয়ে গবেষণা এবং তাঁর সমস্ত মেধা এই সমস্ত কিছুকে একত্রিত করে ঢেলে দিয়েছিলেন সেই উপন্যাসে। অন্যদিকে, দেবেশদা কবিতা পড়তেও খুব ভালবাসতেন আমি তা দেখেছি। সব মিলিয়ে দেবেশদা ছিলেন আমাদের কাছে লেখালিখির একজন আইকন।

একদম শেষের দিকে, যখন আমি আজকাল পত্রিকার প্রকাশনা বিভাগে একটা দায়িত্বে, সেইসময় তাঁর একটা উপন্যাস নিয়ে আমার কাছে খবর আসে। আজকালের পুজোসংখ্যায় একটি উপন্যাসের বেশ কিছু পার্ট লিখেছেন, সেটা তিনি বই হিসাবে প্রকাশ করতে চান। তাঁর সঙ্গে দেখা করি আমি। সেই সময়টা অদ্ভুত। তখন দেবেশদা কানে শুনতে পান না। কানের যন্ত্র লাগিয়ে কথা বলেন। আমি ও আমার বন্ধু-সহকর্মী শুভজিৎ হাজির হই দেবেশদার কাছে। শিলিগুড়ির কবি কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্যের সূত্রেই যোগাযোগটা ঘটে আবার নতুন করে।

দেবেশ রায় আজকালে প্রচুর উপন্যাস লিখেছেন, কিন্তু আজকাল প্রকাশনা থেকে তাঁর কোনো বই নেই। আমরা তাঁর সেই উপন্যাসটিকে বই হিসেবে প্রকাশ করার অনুরোধ জানাই। সম্মত হন তিনি। বলেন, লেখাটি সম্পূর্ণ করে দেবেন আমাদের। সেই শেষাংশটুকু পাওয়া আর হল না। অসম্পূর্ণ উপন্যাসটাই প্রকাশ করব আমরা আগামীতে। দেবেশদা চেয়েছিলেন, তাঁর এই উপন্যাসটা একটু অন্য ফরম্যাটে বের হোক। যেভাবে পুজো সংখ্যায় ইলাস্ট্রেশন থাকে, সেরকম কিছু ছবিও থাকুক। তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ীই আমরা উপন্যাসটিকে আমরা সেই আকারে প্রকাশ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। মনে কষ্ট থেকে যাবে। শেষ হল না লেখাটি। তবে মানুষের জীবনও তো অশেষ। কোনো কিছুই শেষ হয় না। পাঠক স্মৃতিপুঞ্জে, নিজের বাস্তবতায় মনে মনে রচনাটির শেষ অংশ লিখে নেবেন, জানি।