মোম রঙের ১লা বৈশাখ

তখন রোদ ঝরানো চৈত্র শেষের দিন। দাদার ছোট্ট সাইকেলের ক্যারিয়ারে ব’সে বোলপুর টাউন লাইব্রেরি থেকে ‘বীরবলের গল্প’ খুঁজে পাওয়ার সময়। বাড়ির সামনেই একটুকরো খেলার জায়গা। সেখানেই পুজোর বেদি। সন্ধ্যে নামার আগে একটা বাঁশির সুর পাড়ার সকলের জানলা দিয়ে ঢুকে পড়ত ঘরে। ক্লাস ওয়ানের ছেলেটাকে সাতের ঘরের নামতা ভুল করিয়ে দিয়ে সে সুর কোথায় থিতু হত জানি না। কান্তদা পুজোর বেদিতে বসে বাঁশি বাজাত। মা বলত, ওর বাঁশি শুনতে শুনতে ডালে ফোড়ন দিতে ভুলে যাই।

সেই সময়ের বোলপুর-শান্তিনিকেতন মানে খেয়ালখুশির খাতা। ভোরবেলার ইস্কুলে পড়ার কারণে দুপুর বেলায় অনন্ত ফুরসৎ। গরমের দুপুরগুলোয় ঘামে নাইতে নাইতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাখির বাসার দিকে চেয়ে থাকা; কিংবা হর বহুরূপীর একতলায় বসে দাওয়ায় বিশ্রামের সময় মুখোশ চুরি। অথবা কোনও এক অথৈ থেকে হঠাৎ উড়ে আসা রঙিন পালক বা তুলোবীজের পিছনে দৌড়ে তাদের রাফখাতা বন্দি করাই যেন জীবনের লক্ষ্য ছিল। আর ছিল পিঁপড়ের সারি ভেঙে দেওয়ার নিষ্ঠুর খেলা। নাম না-জানা কোনো পোকাকে ফিল্মের কৌটোয় বন্দি করে পিন দিয়ে কৌটোর ঢাকনায় ছিদ্র করে, মাঝেমধ্যে তাকে ঘাস-পাতা, এমনকি রুটির টুকরো দিয়ে লক্ষ করা প্রাণীটি কী করছে। শৈশবের এইসব নিষ্ঠুর জগতের ওপর কখনও কখনও আছড়ে পড়ত দূরের ডাক। ভ্যান রিক্সার চোঙা থেকে ভেসে আসত নতুন যাত্রাপালার নাম, আর রাস্তায় ঝরে পড়ত লাল-সাদা-হলুদ লিফটলেট। কোথায় কোন ভুষুণ্ডির মাঠে পালাগান নামবে আর তার আগে ম্যাজিসিয়ান তার লম্বা হাতার ভিতর থেকে এক ঝাঁক পায়রাকে উড়িয়ে দেবেন আকাশে, এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই রোদের তাপ কমত, ছুটতাম ডাকবাংলোর মাঠে। সেখানে তখন নানা বয়সী বন্ধুরা খেলার পসরা সাজিয়ে বসে আছে।

চৈত্র শেষ হওয়ার দু সপ্তাহ আগে বাড়িতে আসত খান তিনেক আর্ট পেপার। দাদার জন্য দুটো আর আমার একটা। কাগজ কেটে কেটে কার্ডের আকার দেওয়া। তারপর কখনও মোম রঙের আকাশ, নৌকো, নদীর সংসার তো কখনও খামার বাড়ি, কলাগাছ ফুটিয়ে তোলার সাধনা। আর এই স্বল্প আয়োজনে কারুবাসনা না মিটল তো ভাল। না-হলে পুরনো কাগজ বা পিচবোর্ডের টুকরোই সহায়। কবজি বিশেষ ঘুরত না ব’লে মানুষ আঁকার বাসনা প্রায় ছিল না বললেই চলে। দাদা রাখাল আঁকতে ভালোবাসত। সে রাখাল উদাস পায়ে হেঁটে চলা বালক। হাতে তার বাঁশি। প্যাস্টেলের ঘাসে চড়ে বেড়ানো গাভী আর বাছুর। পাশের বাড়ির মাধুদা তখন পেন দিয়ে চোখের নানান ধরতাই ধরতে ব্যস্ত। একবার আমাকে দেওয়া গ্রিটিংস কার্ডের ওপর দেখি তেরছা চোখে এক মহিলার হাতে চায়ের কাপ। বুঝলি কিছু? সন্তর্পণে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল মাধুদা। আমি বললাম, না তো। বললো মহিলার চোখটা দেখেও বুঝলি না? আমি ঘাড় নাড়তে কানের আরও কাছে এসে ততোধিক ফিসফিসিয়ে বললো, চায়ে বিষ মিশিয়েছে। শুনেতো আমি চিত্তির। সভয়ে জিজ্ঞেস করলুম, চা টা খাবে কে? অম্লানবদনে মাধুদা বলল, সেটা এখনও ঠিক করিনি।

নববর্ষের সকালে শান্তিনিকেতন থেকে ফিরেই বন্ধুদের সেই কার্ড বিতরণ করার পালা।

বন্ধুদের দেওয়া গ্রিটিংস কার্ডের ছবিতে গোলাপের আধিক্য। গোপাল আমার অসম বয়স্ক বন্ধু। ওর কার্ডে আঁকা গোলাপের সঙ্গে প্রতিবারই চিনেম্যানদের দাড়ির মতো খান তিনেক কাঁটা। স্কুলে বন্ধুদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় তাদের জন্য ছোটো ছোটো কার্ড বানানোর রীতি ছিল। আনতাবরি ঝরনা কলম ঝাঁকিয়ে কার্ডের ওপর অদ্ভুত দর্শন ছবি তৈরি করার নেশা লেগে গিয়েছিল। সারা বছর রং-পেনসিলের হদিস না পাওয়া গেলেও চৈত্র শেষের এই কটা দিন তারা গুপ্ত স্থান থেকে ‘এসো হে বৈশাখ’ গাইতে গাইতে বেরিয়ে আসত।

পাশের বাড়ির তানিদি কলেজে পড়ত। লেখাপড়া আর ছবি আঁকা দুয়েতেই ছিল যাকে বলে তুখোড়। আর গানের গলা শুনে আমরা ছোটো-বড়ো সকলেই উদাস হয়ে যেতাম। আমাদের বাড়িওলির বড় মেয়ে ফরিদাদি, পান চিবোতে চিবোতে বড় বড় চোখ করে মায়ের কাছে গল্প করত, দেখো মামিমা, আমাদের তানির রাজার ঘরে বে হবে।

প্রতিবার তানিদির কাছ থেকে কার্ড পাওয়ার একটা আলাদা উত্তেজনা ছিল। কার্ডের সঙ্গে মিলত ঝাল লজেন্স।

তাছাড়া সকলের থেকে তানিদি আমায় একটু বেশিই ভালোবাসে এমন একটা বিশ্বাস ছিল তখন। ঝড়ে কাঁচা আম কুড়োনোর সময় আমাকে চুপিচুপি বাড়ি থেকে ডেকে নিত। তারপর ব্লেড দিয়ে সেই আম কেটে বাড়ি থেকে চুরি করে আনা সরষের তেল, বিটনুন আর আখের গুড় দিয়ে যত্ন করে মেখে নিজের হাতে খাইয়ে দিত। হয়ত ওদের বাড়ি খেলতে গেছি, কোথা থেকে উড়ে এসে একখণ্ড মণ্ডা আমার মুখে পুরে দিয়ে আঙুলের ইশারায় চুপ দেখিয়ে হারিয়ে যেত কোথায়।

তানিদি সেবার খামে ভরা কার্ড দিয়ে বলল, এখানে নয় বাড়ি গিয়ে দেখিস। পরে খাম খুলে দেখি এক তন্ময় মূর্তি বাঁশি বাজাচ্ছে। মুখশ্রী অবিকল কান্তদার। দাদাকে দেখাতে বাঁকা হেসে বলেছিল, ও তুই বুঝবি না। সে বছরই আষাঢ় মাসের পয়লায় গলায় দড়ি দিল তানিদি।

হারানো গ্রিটিংস কার্ডগুলোর দিকে এখন প্রায়শই স্মৃতির চোখ আবছা ফিরে ফিরে চলে যায়। দেখতে পাই এক অস্পষ্ট সুর ভেসে বেড়াচ্ছে শান্তিনিকেতনের হাওয়ায়।

আজ বুঝি কান্তদার বাঁশির সুর ক্লাস ওয়ানের ছেলেটাকে সাতের ঘরের নামতা ভুল করিয়ে দিয়ে বেড়িয়ে পড়ত। তানিদির মতো আরও অনেকের জীবনটা এলোমেলো ক’রে দিতে।