লকডাউন পর্বের মধ্যে প্রাথমিকভাবে কাজের গতিতে ভাঁটা পড়লেও, কিছুদিন পর থেকেই বেড়েছিল বাড়ি থেকে কাজের নতুন অভিজ্ঞতা। স্বাভাবিকভাবেই টেলিকম কোম্পানিগুলি আশা করেছিল, ইন্টারনেট ব্যবহার অবশ্যম্ভাবী হওয়ায় বাড়বে গ্রাহক সংখ্যাও। কিন্তু বাস্তবে ছবিটা দেখা গেল উল্টো। গত মে মাসের পরিসংখ্যান বলছে ভারতে দু’টি প্রধান টেলিকম সংস্থা ভারতী এয়ারটেল এবং ভোডাফোন আইডিয়া ব্যাপক গ্রাহক হারিয়েছে ওই মাসে। টেলিকম নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘ট্রাই’-এর হিসেব মতে, গত মে মাসে সারা দেশে টেলি গ্রাহকের সংখ্যা কমেছে ৫৭.৬ লক্ষ। এর আগের মাসেও প্রায় পঁচাশি লক্ষ কমেছিল টেলিকম গ্রাহকের সংখ্যা। শিল্প মহল এর জন্য দায়ী করেছে দেশজুড়ে লকডাউন, আর্থিক সংকট, কর্মক্ষেত্রে ধাক্কা এইসব চর্চিত বিষয়গুলিকেই।
প্রকাশত রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধুমাত্র মে মাসেই ভারতী এয়ারটেল এবং ভোডাফোন আইডিয়া প্রত্যেকে প্রায় ৪৭ লক্ষেরও বেশি গ্রাহক হারিয়েছে। যদিও পরিস্থিতিটা একদমই উল্টো মুকেশ আম্বানির সংস্থা রিলায়েন্স জিওর। করোনার সময় ক্রমশই ফুলে-ফেঁপে উঠেছে জিওর ব্যবসা। এয়ারটেল এবং ভোডাফোনের শোচনীয় অবস্থার মধ্যেই প্রায় ৩৭ লক্ষের বেশি গ্রাহককে নিজেদের পরিষেবার আওতায় এনেছে রিলায়েন্স জিও।
ট্রাইয়ের এই রিপোর্টে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে দেশের আর্থিক বৈকল্য। লকডাউনের কারণে যেমন শহরাঞ্চলে কাজ হারিয়েছেন ব্যাপক পরিমাণে মানুষ, তেমনি কাজ হারিয়ে শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে ফিরে এসেছেন অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিক। এর ফলে টু-জি, থ্রি-জি এবং ফোর-জি গ্রাহকের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে প্রায় ০.৫ শতাংশ।
ট্রাই-এর রিপোর্ট থেকেই দেখা যাচ্ছে যে, এয়ারটেল এবং ভোডাফোন সংস্থা দু’টি ব্যাপক পরিমাণে গ্রাহক সংখ্যা হারানোর ফলে বর্তমানে ৩০ কোটির আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে তাদের গ্রাহক সংখ্যা। যেখানে জিওর গ্রাহক সংখ্যা বর্তমানে ৪০ কোটি ছুঁইছুঁই। গ্রামাঞ্চলের পাশাপাশি শহরেও ব্যাপক কমেছে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা। প্রায় ৯২ লক্ষ টেলিকম গ্রাহক কমেছে শহরাঞ্চলে।
আরও পড়ুন
ভারতের ইতিহাসে প্রথম মোবাইল কলের সঙ্গে জড়িয়ে জ্যোতি বসুর নাম
কিন্তু কেন এমন হাল হল দেশের টেলিকম পরিষেবার? একটু পিছনে গিয়ে দেখলে দেখা যাবে, গতবছর ৫ সেপ্টেম্বর রিলায়েন্স জিও প্রায় বিনামূল্যে গোটা দেশে ফোর-জি পরিষেবা দেওয়ার কথা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গেই বাকি টেলিকম সংস্থাগুলি বিপদের আভাস পেয়েছিল। জিওর সঙ্গে লড়াইতে টিকে থাকার জন্য এয়ারটেল বা ভোডাফোনের মতো কোম্পানিগুলিকে অনেকটা কমাতে হয়েছিল ডেটা প্যাকের মূল্য। প্রতিযোগিতা আরও বাড়তে থাকে লকডাউন পর্বে। বাড়িতে বসে কাজ, সঙ্গে অনলাইনে ক্লাস এসব কিছুর জন্যই হাই স্পিড ডেটা আবশ্যক হয়ে পড়েছিল। সেই সুযোগ কাজে লাগাতেই জলের দরে ইন্টারনেট পরিষেবা নিয়ে এসেছিল ভোডাফোন এবং এয়ারটেল। বিশেষ করে ভোডাফোন যে ‘বেশি টাকায় বেশি গতির ডেটা’ অফার নিয়ে এসেছিল, তাকে অসচ্ছ ও টেলি পরিষেবার নীতিবিরোধী বলে সংস্থাকে শোকজ নোটিশও ধরিয়েছিল ট্রাই। ক্ষতির বোঝা বইতে না পেরে তার আগেই ইন্টারনেট পরিষেবার মূল্য বাড়িয়েছিল এয়ারটেল। সব মিলিয়ে প্রতিযোগিতার বাজারে শুধুমাত্র গ্রাহকদের ‘লয়ালিটি’র জোরে টিকে থাকার আশা নিয়ে ভোডাফোন বা এয়ারটেল বসে থাকলেও, আদতে দেখা যাচ্ছে যে উদ্ভূত পরিস্থিতির লাভের গুড় খেয়ে গেল আম্বানির সংস্থাই।
বিশেষ করে ভোডাফোন যেভাবে বিপাকে পড়েছে তাতে টেলিকম প্রতিযোগিতার বাজারে মূলত লড়াইটা হয়ে দাঁড়িয়েছে জিও এবং এয়ারটেলের মধ্যেই, মত বিশেষজ্ঞদের। অর্থনীতির ভাষায় বলতে গেলে এই ধরনের বাজারকে বলা হয় ‘ডুয়োপলি’। অর্থাৎ দু’টি প্রধান সংস্থাই মূলত নিয়ন্ত্রণ করে সম্পূর্ণ বাজার; এবং, এক্ষেত্রে পরবর্তীকালে যদি দাম বাড়তে থাকে অবাধে, তবে ক্রেতাদের অসহায় ভাবে তা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না আর কোনও।
আরও পড়ুন
বিপুল আর্থিক ক্ষতি ভোডাফোনের, আপোষ করা হবে পরিষেবায়?
যদিও প্রশ্ন এক্ষেত্রে থাকছেই। ভোডাফোনের বিরুদ্ধে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর প্রশ্ন উঠছে যে, এর আগে এয়ারটেলের বিরুদ্ধেও এই একই অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু তখন এই ধরনের কোনও শোকজ নোটিশ পাঠানো হয়নি ভারতী এয়ারটেল সংস্থাকে। পরবর্তীকালে এয়ারটেল অফারটি প্রত্যাহার করে নেয়। তাই টেলিকম বাজার থেকে ভোডাফোনকে কার্যত মুছে দেওয়ার জন্যই কোনো চক্রান্ত কাজ করছে কিনা, সেটা নিয়ে ধন্ধ কিন্তু একটা থেকেই যায়।
অর্থনীতির নিয়মেই বলে, প্রতিকূল পরিস্থিতি কিংবা এমার্জেন্সির সময় একমাত্র নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়া চাহিদা কমে যায় ‘লাক্সারি গুড’ বা বিলাসবহুল দ্রব্যের। এক্ষেত্রেও ক্রমাগত টেলিকম সংস্থার বাজারে এই পতন কি দেশের শোচনীয় আর্থিক পরিস্থিতির দিকেই নির্দেশ করছে না? সুতরাং যতই দেশের ভালো সময়ের কথা বলা হোক, আদতে ভাঁড়ারে যে টান পড়ছেই, সেই ছবিটা কিন্তু স্পষ্ট হচ্ছে ক্রমশ। সুস্থ প্রতিযোগিতা না থাকলে যদি একটি বা দু’টি মাত্র দ্রব্য গোটা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, তবে তার অনিবার্য পরিনাম হল মূল্যবৃদ্ধি। সুতরাং এই পরিস্থিতি যে দেশের নতুন প্রজন্মের কাছে একদমই কাঙ্ক্ষিত নয় সে কথা বলাই বাহুল্য। দেশের নীতিনির্ধারকেরা অর্থনীতি সহজ সত্যিটা তাই যেন ভুলে না যান, সেটাই এখন কাম্য।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
আরও পড়ুন
১৮৮১ নয়, তার পাঁচ বছর আগেই কলকাতা শুনেছিল প্রথম টেলিফোনের আওয়াজ
Powered by Froala Editor