খেড়িয়া-শবর সম্প্রদায়ের প্রথম স্নাতক পুরুলিয়ার রমনীতা, তৈরি হল ইতিহাস

প্রকৃতিকে সঙ্গী করেই জীবনযাপন করতেন তাঁরা। ছিল না স্থায়ী বসতিও। তবে ধীরে ধীরে এগিয়েছে পুরুলিয়ার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী শবর সম্প্রদায়। কিন্তু অর্থ-সামাজিক বৈষম্য কাটেনি আজও। শিক্ষার আলো পৌঁছালেও তা ব্যাপকতা পায়নি শবর সম্প্রদায়ের মধ্যে। আর মহিলাদের ক্ষেত্রে হলে সেই পথ আরও সংকীর্ণ। তবে এবার সেই বেড়াজাল ভেঙেই বেরিয়ে এলেন খেড়িয়া-শবর সম্প্রদায়ের যুবতী রমনীতা শবর। প্রথমবারের জন্য খেড়িয়া-শবর সম্প্রদায়ের কোনো ছাত্রী অর্জন করলেন স্নাতক ডিগ্রি।

পুরুলিয়ার বরাবাজারের ফুলঝোর গ্রামের বাসিন্দা রমনীতার বিষয় ছিল ইতিহাস। পুরুলিয়া ঘেঁষা ঝাড়খণ্ডের পটমদা ডিগ্রি কলেজের ছাত্রী ছিলেন রমনীতা। ইতিহাস সাম্মানিকে শুধু পাশই নয়, বরং ফার্স্ট ক্লাস পেয়েই স্নাতক হলেন তিনি। তৈরি করলেন এক নতুন ইতিহাস। রমনীতার আগে বেশ কয়েকজন খেড়িয়া-শবর ছাত্রী কলেজে ভর্তি হলেও পড়াশোনা শেষ করার সুযোগ হয়নি তাঁদের ক্ষেত্রে। অন্যদিকে লোধা-শবরদের মধ্যে বছর কয়েক বছর আগে প্রথম মহিলা স্নাতক হয়েছিলেন চুনী কোটাল।

“এটা গোটা গ্রামের কাছে বিরাট বড়ো গর্বের বিষয়। কিন্তু একটা রমনীতা তৈরি হলেই তো এগিয়ে যাওয়া যাবে না। আরও দশজন রমনীতা উঠে এলে উন্নতি হবে গোটা সম্প্রদায়ের। সেক্ষেত্রে রমনীতা নিজে একজন উদাহরণ হয়ে থাকল। ওকে সামনে রেখেই নানাভাবে উদ্যোগ নিতে হবে আমাদের। যাতে আরও পাঁচটা অভিভাবক এগিয়ে আসেন রমনীতা তৈরির জন্য”, বলছিলেন শবর কল্যান সমিতির অন্যতম সদস্য এবং শিক্ষক নির্মল শবর। 

তবে শুধুমাত্র নিজেকে পড়াশোনার মধ্যে সীমিত রাখেননি রমনীতা। পুরুলিয়ায় শবর সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নির্মিত স্কুল ‘স্বপ্নের স্কুলবাড়ি’-তে শিক্ষকতাও করে চলেছেন তিনি। পাশাপাশি বিভিন্ন শবর-গ্রামের ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগও করে চলেছেন তিনি। উদ্বুদ্ধ করছেন পড়াশোনার মধ্যে নিজেদের পৃথিবী খুঁজে নেওয়ার জন্য। ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষাক্ষেত্রের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য।

আরও পড়ুন
তফসিলি উপজাতির মানুষ এবার মন্দিরের পুরোহিত, ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে নজির কেরালায়

শবর সম্প্রদায়ের ছাত্রীদের ক্ষেত্রে পড়াশোনায় একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় বিবাহ। স্বল্পবয়সেই সংসারী হওয়ার দরুন বন্ধ হয় স্কুল-কলেজের দরজা। অত্যন্ত সচেতনভাবেই সেই গন্ডি ঠেলে বেরিয়ে এসেছেন রমনীতা। ফিরিয়ে দিয়েছেন বিবাহের প্রস্তাব। তাঁর মূল লক্ষ্যই এখন পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া স্নাতকোত্তর বিভাগে। প্রহরের সঙ্গে কথায় রমনীতা জানালেন, “ডিএম সাহেব ডেকেছিলেন আমাকে কাল। উনি পুরুলিয়ার সিধো-কানহো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেবেন। ইতিহাস নিয়েই পরবর্তী স্তরের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই আমি।” সেইসঙ্গে তাঁর কথায় উঠে আসে স্বল্প বয়সে বিবাহের প্রসঙ্গও, “আমি বাড়ি থেকে সেই স্বাধীনতাটা পেয়েছি পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য। তবে সবার ক্ষেত্রে তো এমনটা হয় না একেবারেই। গ্রামে গ্রামে গিয়ে অভিভাবকদের বোঝাই। অনেকেই তাঁরা আশ্বস্ত করেন পড়াশোনার এই বয়সে বিবাহ দেবেন না মেয়েদের। তবে হয় না অনেক সময়ই। তবু চেষ্টাটা চালিয়ে যাচ্ছি, চালিয়ে যাব আগামীতেও।”

খেড়িয়া-শবর সম্প্রদায়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনেকটা দায়িত্বই নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন রমনীতা। এখন রমনীতাই গোটা সম্প্রদায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে অনুপ্রেরণা। এগিয়ে যাওয়ার বিপ্লবের সূত্রপাতটা করলেন তিনিই। সেই আগুন যে ছড়িয়ে পড়বে বাকিদের মধ্যেও দ্রুত, তা নিশ্চিতই একপ্রকার...

আরও পড়ুন
ভারতীয় বংশোদ্ভূতের পাশেই উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ, বৈচিত্র্যের সমাহার নিউজিল্যান্ডের মন্ত্রিসভায়

Powered by Froala Editor

More From Author See More