অর্ধনারীশ্বর-আরাধনা ও রূপান্তরকামী-বৃহন্নলাদের শারদীয়া

‘দুর্গাপুজো তো সর্বজনীন। এই সময়টায় সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসবে অংশ নেন। কিন্তু আমাদের ব্যাপারটা ঠিক এর উল্টো। আমাদের এই সময়টাতেই আইসোলেট হতে হয়। আমরা তখন গৃহবন্দি থাকতে হয়। কারণ, পরিবারে কিংবা বাইরে বুলিং-এর মাত্রাটা বহুগুণ বেড়ে যায়। বিভিন্ন ধরনের কটূক্তি, হাসাহাসি, গালাগালির শিকার হতে হয়েছে আমাদের। এমনকি গায়ে গরম জল পর্যন্ত ঢেলে দেওয়া হয়েছে।’

বলছিলেন ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ ট্রান্সজেন্ডার অ্যান্ড হিজড়া ইন বেঙ্গল’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যা রঞ্জিতা সিনহা। 

‘নির্জন দ্বীপের বাতিঘরের শিখরে তার বসতি, তিনি অর্ধনারীশ্বর…’ সুনীলের লেখা এই পংক্তির সঙ্গে পরিচিত অনেকেই। হ্যাঁ, কথা হচ্ছে রূপান্তরকামী এবং বৃহন্নলাদের নিয়েই। তাঁদের পরিচয় আইন স্বীকৃত হলেও, বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে আজও মুক্তি পাননি তাঁরা। উৎসবের মরশুমে, দেবী আরাধনার ঋতুতে যেন আরও বেড়ে যায় সেই বিভেদ। অথচ, পুরাণ কিংবা বেদেও উল্লেখিত হয়েছে অর্ধনারীশ্বরবাদ।

কিন্তু চিরকালই কি পুরুষতন্ত্রের চাকার নিচে পিষে যাবে তাঁদের উৎসব-আনন্দে সামিল হওয়ার অধিকার? চিরকালই ব্রাত্য থেকে যাবেন তাঁরা? না। বরং, প্রথা ভেঙে তাঁরা নিজেরাই তৈরি করে নেন আরাধনার এক টুকরো খোলা আকাশ। যেখানে আনন্দে সামিল হতে ভয় নেই কোনো। নেই বাধা নেই অঞ্জলি দেওয়াতে। ‘মূর্তিপুজো, পৌরোহিত্য, ভোগ রান্না থেকে সবটাই যাতে আমরা নিজেরা করতে পারি এটাই ছিল আমাদের মূল উদ্দেশ্য’, বলছিলেন রঞ্জিতা সিনহা। 

আরও পড়ুন
শিখ ধর্মগ্রন্থে চণ্ডী-মাহাত্ম্য

আরও পড়ুন
শরৎ আসে শরৎ যায়, কীভাবে দিন কাটে সাবেক ছিটমহলবাসীদের?

বছর চারেক আগের কথা। ২০১৭ সালে ঠিক এভাবেই কলকাতায় শুরু হয়েছিল বৃহন্নলাদের মানুষদের উৎসবযাপন। রঞ্জিতার হাত ধরে গোখেল রোডের রেজিস্ট্রেশন অফিসে আয়োজিত হয়েছিল শারদোৎসব। তবে খুব কিছু সহজ ছিল না এমন একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন। ‘তবে দুর্গাপুজোটা আমরা করে উঠতে পারব তা কখনো ভাবতে পারিনি। দুর্গাপুজোর একটা বাজার আছে। তার ব্যয়বহুল খরচও আছে।’ পাশাপাশি তাঁরা যে ‘অন্যরকম’। ফলে, সমাজের একটা বড়ো অংশও তাঁদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত ছিল না। 

আরও পড়ুন
রুখা দেশের দুর্গাপুজো— শৈশবস্মৃতি

তবে সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে হার মানিয়েই সেবার অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছিলেন তাঁরা। ১৯৯৯ সালে যে শহর দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ‘প্রাইড ওয়াক’-এর সাক্ষী ছিল, সেই কলকাতাতেই ট্রান্সজেন্ডার দুর্গাপুজোর আয়োজনে যেন আরও একবার বিভেদরেখা ভেঙে সেই অধিকারের দাবিই প্রতিষ্ঠা করেন রঞ্জিতা সিনহারা। দুর্গাপুজো বলা খানিক ভুল হবে হয়তো। কেননা, দুর্গা প্রতিমার বদলে এই পুজোয় ফুটে ওঠে শিব-পার্বতীর অর্ধনারীশ্বর চেহারা। তাঁরাও এই সমাজেরই অংশ, আইনের পাশাপাশি ভারতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গেও জুড়ে রয়েছে তাঁদের অস্তিত্ব— এই বার্তা তুলে দিতেই এই উদ্যোগ।

শুধু মূর্তিতেই নয়, আর পাঁচটা পুজোর থেকে অন্যান্য ক্ষেত্রেও আলাদা রঞ্জিতাদের এই অর্ধনারীশ্বর আরাধনা। জানা গেল, এই পুজো হয় বৈষ্ণব মতে। পাশাপাশি পৌরোহিত্য থেকে শুরু করে বিজয়া— সমস্ত আচার-রীতিতেও একাধিক বদল এনেছেন তাঁরা। তার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে দীর্ঘ গবেষণা। পুরোহিতের ভূমিকাতেও দেখা যায় রূপান্তরকামীদের। রঞ্জিতা সিনহার মুখেই শোনা গেল সেই কথা, ‘প্রথম বছর একজন ট্রান্সম্যান পৌরোহিত্য করেছিলেন। পরেরবার একজন ট্রান্সওম্যান। এভাবেই প্রতিবছর ধারাবাহিকভাবে আমরা বদলটা করি।’ তাঁর কণ্ঠস্বরে যেন বারবার ফুটে উঠছিল লিঙ্গসাম্যের কথাই। শুধু রূপান্তরকামী কিংবা বৃহন্নলারাই নয়, ক্রমে এই পুজোর অংশ হয়ে উঠেছেন সমাজের সমস্ত প্রান্তিক লিঙ্গ যৌনতার মানুষেরাই। উৎসবের মরশুমে তাঁরাও দু’দণ্ড ফুরসৎ খুঁজে নিয়েছেন এই ভিন্ন শারদোৎসবে।

বিগত চার বছরের মতো এবারেও ছেদ পড়েনি সেই রীতিতে। চলতি বছরেও আয়োজন হয়েছে অর্ধনারীশ্বর আরাধনার। শুধু বদলে গেছে জায়গাটা। গোখেল রোড থেকে স্থানান্তরিত হয়ে এবার পুজোর আয়োজন হয়েছে ভারতবর্ষ তথা দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ট্রান্সজেন্ডার শেল্টার হোম ‘গরিমা গৃহ’-এ। বর্তমানে এই হোমের আবাসিক সংখ্যা প্রায় কুড়ি জন। তাঁদের সকলেই বাড়ি থেকে বিতাড়িত। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এই মানুষগুলোর মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠবে, উৎসবের সৌজন্যে গমগম করবে আশ্রয়কেন্দ্র— তা বলার অপেক্ষা থাকে না। 

কিন্তু শুধুই কি উদযাপনে স্বার্থকতা এই আয়োজনের? না, বরং সমাজের প্রচলিত ট্যাবুও ধীরে ধীরে হার মানছে অর্ধনারীশ্বরবাদের সামনে। বছর দুয়েক আগে জঙ্গলমহলের একটি দুর্গোৎসব কমিটি দরজা খুলে দিয়েছিল রূপান্তরকামী এবং বৃহন্নলাদের জন্য। তাঁদের হাতেই সেবার রান্না হয়েছিল দেবীর ভোগ। চলতি বছরে সুকিয়া স্ট্রিটের শতাব্দীপ্রাচীন বারোয়ারি পুজো বৃন্দাবন মাতৃমন্দিরেও থিম হিসাবে ফুটে উঠেছে তাঁদের কথা। আর সে-পুজোর রূপদান করেছেন একজন রূপান্তরকামী নারীই। চেতনার এই বদল যে অর্ধনারীশ্বর পুজোর সূত্র ধরেই, তা অস্বীকার করার জায়গা নেই কোনো। স্বাধীনতার সাড়ে সাত দশক পেরিয়ে এসে এই বদল নতুন করে আশা দেখাচ্ছে সুদিন আসতে খুব বেশি দেরি নেই আর…

Powered by Froala Editor

More From Author See More