জাতিভেদের বিরুদ্ধে লড়াই, 'অস্ত্র' মেয়েদের ফুটবল ক্লাবও - দিনবদলের স্বপ্ন বুনছেন প্রতিমা

“এই আধুনিক ভারতে দাঁড়িয়েও, আজও জাতপাতের মতো ঘটনা ঘটে আমাদের সমাজে। দলিতদের নিচু চোখে দেখা হয়, অত্যাচার হয়। শুধু যে ব্রাহ্মণরা বা উঁচু জাতিরাই এটা করে, তা নয়। দলিতদের মধ্যেও তো আলাদা আলাদা সম্প্রদায় আছে। তাদের মধ্যেও এই বৈষম্য, ছোঁয়া-না ছোঁয়ার ব্যাপার দেখা যায়। কাজের ওপর ভিত্তি করে ছোটো-বড়ো ঠিক করা হয়। আমার লড়াই এই ভেদাভেদ নিয়েই। প্রতিটা বাড়ি থেকে এই লড়াই যাতে শুরু হয়, আর মেয়েরাও যাতে এই লড়াইয়ের মাধ্যমে একটা জায়গা পায়, সেটাই লক্ষ্য আমার।”

প্রহরকে এমনটাই বলছিলেন প্রতিমা কুমারী পাসোয়ান। তথাকথিত ‘সিডিউল কাস্ট’ বলতে আমরা যাঁদের বুঝি, ইনি তাঁদেরই একজন। ভালোভাবে বললে, একজন দলিত। আজকের একবিংশ শতকের আধুনিকতায় দাঁড়িয়েও তাঁর এমনভাবে পরিচয় দিতে হচ্ছে। কারণটা আমরা চারদিকে তাকালেই বুঝতে পারব। একই কথা বলছেন প্রতিমাদেবীও। জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা আজও যে সমাজের বুক আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে!

আরও একটি প্রজাতন্ত্র দিবস পেরিয়ে এসেছি আমরা। তর্কে-বিতর্কে আমাদের মুখে উঠে আসে সংবিধানের প্রসঙ্গ। কিন্তু সত্যিই কি সমস্ত জায়গায় সংবিধানের সঠিক পালন হয়? কথা চলাকালীন এই কথাটাই উঠে আসে প্রতিমা পাসোয়ানের মুখে। ছোটো থেকে নিজের বাড়িতে, নিজের সমাজে দেখে এসেছেন ভেদাভেদ। ছেলে-মেয়ে, জাতি, কাজ— সমস্ত কিছুতে ছোটো-বড়ো’র সংজ্ঞা ‘সুবিধামতো’ তৈরি করে রেখেছি আমরা। শিক্ষার সুযোগও দেওয়া হয় না।

নিজের ছোটোবেলাতেও এমনটা দেখেছেন প্রতিমা। পড়াশোনার সুযোগ তিনি পাননি। জন্ম থেকেই তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল একটি শব্দ - দলিত। শুধু দলিত নয়, নিচু জাতের দলিত। তাঁদের সঙ্গে কেউ খেত না, কেউ ডাকতও না। এমনকি শিক্ষারও সুযোগ ছিল না। বাড়িতে মাও অসুস্থ ছিলেন। একার চেষ্টায় নিজের ভাইদের বড়ো করেছেন, নিজেও বড়ো হয়েছেন। সেই সঙ্গে দেখেছেন সমাজের কালো রূপটা। নিজেদের জীবনে তো বটেই, আশেপাশের মানুষগুলোও সেই ঝাপটা সহ্য করেছেন।

এই সময়ই দুটো ঘটনা ঘটে জীবনে। একবার পরিচিত একজনের বাড়িতে খেতে গেছেন প্রতিমা। খাওয়া দাওয়া হয়ে যাওয়ার পর ওই বাড়ির একটি বাচ্চা ছেলে এসে থালাগুলো নিয়ে গেছে ধোয়ার জন্য। সেটা দেখে চিৎকার করে উঠল বাড়ির মহিলারা। ‘এ কী করলি! ও যে দলিত, নিচু জাত। ওর খাওয়া থালা তুই ধুচ্ছিস কেন? সব গেল! জাত গেল!’ অবাক হয়ে গিয়েছিলেন প্রতিমা। মেয়েরাই এমন বলছে!

আরেকটি ঘটনা ঘটে বড়ো হওয়ার পর। সেটা পাটনায়। একটি প্রোজেক্টের কাজে যুক্ত ছিলেন প্রতিমা। সেটা সফল হবার পর একটি বাড়িতে সাকসেস পার্টির বন্দোবস্ত হয়। খাওয়া দাওয়ার পর, ওই বাড়ির একজন এসে তাঁকে বলে, ‘তোমাদের জাতের লোকেরা কী করে সেটা তো আমরা সবাই জানি। আজ তো আমাদের বাড়ি কাজের লোক আসেনি। তুমি তোমার প্লেটটা একটু ধুয়ে নাও’। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। যেখানে তিনি একজন আমন্ত্রিত, সেখানেই তাঁকে এসব বলা হচ্ছে!

সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি সেদিন। অবশ্য অপমান তো তাঁর ছোটো থেকেই সঙ্গী। তাঁর, এবং তাঁর মতো আরও হাজার মানুষের। কত মানুষকে এর থেকেও খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়! প্রতিমা পাসোয়ান ঠিক করলেন, এভাবে আর না। সমাজের সব জায়গায় সচেতনতা বাড়াতে হবে। সমস্ত ঘরে পৌঁছে দিতে হবে শিক্ষার আলো। তাহলেই যদি কিছু করা যায়…

“আজও অনেকে এই জাতিভেদ প্রথাকে পরম্পরা বলে মনে করে। তবে আমার মনে হয়, রাজনৈতিক ভাবেও এই ভেদাভেদকে তৈরি করে রাখা হচ্ছে। সেটা আজকে নয়, অনেকদিন ধরে। মুছতে দেওয়া হচ্ছে না। যদি শিক্ষা আসে, যদি এসব দেওয়াল মুছে যায়, তাহলে আমরা সবাই একসঙ্গে আসব। এটাই তো দেশ। এটাই তো ধর্ম। সেটাই অনেকে রাজনৈতিকভাবে চাইছেন না। সেইজন্য শিক্ষার আলোও পৌঁছচ্ছে না।” দৃঢ়ভাবে এই কথাগুলো বলেন তিনি।

সচেতনতা যে পৌঁছচ্ছে না, সেটার উদাহরণ হিসেবে প্রতিমা বললেন নাট বলে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের কথা। মাদারির খেলা দেখিয়ে এদের রোজগার। এক জায়গায় ঘর বেঁধে এরা থাকে না কখনও। সেই কারণে আজও ঘর দেওয়া হয় না তাদের। লোকে অবিশ্বাস করে। পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগও প্রায় পাওয়া যায় না বললেই চলে। এরকম বহু উদাহরণ ছড়িয়ে আছে।

এই ছবিটাকেই বদলাতে চান প্রতিমাদেবী। এই পরিস্থিতি তাঁকে মানসিকভাবে আরও শক্ত করেছে। সেটাই সমস্ত জায়গায় ছড়িয়ে দিতে চান তিনি। বিশেষ করে, মহিলাদের উপরই তিনি গুরুত্ব দিতে চান। আজও সমাজের একটা বড় অংশে মহিলাদের কাজ শুধু সন্তান মানুষ করা। যত শিক্ষা ঢুকছে, যত তারা জাগছে, তত বেশি করে চেপে ধরা হচ্ছে তাদের। কাজ করা যাবে না। সেই সঙ্গে চলছে মারধোর। এমনকি, বাল্য বিবাহও অনেক জায়গায় হয়। এখান থেকেই মহিলাদের তুলে ধরতে চান তিনি।

তবে বদল আসছে। হ্যাঁ, এটাই জোর গলায় বলছেন প্রতিমা পাসোয়ান। অল্প সংখ্যায় হলেও, আস্তে আস্তে জাগছে যুব সমাজ। আজ দলিতরা পড়তে যাচ্ছে, উচ্চশিক্ষা করছে, চাকরিও করছে। বাড়ি থেকেও তাঁদের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে এসবের জন্য। যাতে আরও জায়গায় এসব হয়, সেটারই চেষ্টা করছেন তাঁরা। পণপ্রথা, বাল্যবিবাহ এসব চলবে না একদমই। লোকজন রাগ করে, উল্টোপাল্টা বলে; কিন্তু পরে গিয়ে বুঝতেও পারে। আজ দলিত মেয়েদের নিয়ে দুটো ফুটবল টিম তৈরি করেছেন তিনি। আম্বেদকর মহিলা ফুটবল ক্লাব, আর সাবিত্রীবাঈ ফুলে মহিলা ফুটবল ক্লাব। পায়ে বল নিয়ে মেয়েরা দৌড়চ্ছে জেলা থেকে জেলায়। সব জায়গা থেকে ডাকও পাচ্ছে তারা।

প্রতিমা পাসোয়ান তো এই দৌড়েরই স্বপ্ন দেখেছিলেন। আপাতত এই সবকিছুর পাশাপাশি তাঁর লক্ষ্য কর্মসংস্থানের। লোকে যাতে কাজ পায়, দলিত মেয়েরা যাতে এইসব ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে স্বাধীন ভাবে বাঁচতে পারে, সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছেন তিনি। এইভাবেই হয়তো একদিন ভেঙে যাবে সমস্ত দেওয়াল…

More From Author See More