প্রধানমন্ত্রী হলে, 'শ্রেষ্ঠ' হতেন তিনিই? প্রণব মুখোপাধ্যায় ও পাঁচ দশকের রাজনীতি

সদ্য একটি কলেজ তৈরি করেছেন দক্ষিণ ২৪ পরগণার বিদ্যানগর গ্রামে। হরেন্দ্রনাথ মজুমদারকে মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছিল সেই একটি উদ্যোগ। আর তার পরেই রাজনীতির প্রত্যক্ষ ময়দানে প্রবেশ। সেটা ১৯৬৭ সাল। বাংলার রাজনীতিতে তখন একটা টালমাটাল পরিস্থিতি। জাতীয় কংগ্রেস ছেড়ে নতুন একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করেছেন ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা অজয় মুখোপাধ্যায়। সেই সদ্যগঠিত দল ‘বাংলা কংগ্রেস’-এর হয়ে বিধানসভার প্রার্থী হলেন হরেন মজুমদার। দলের বড়ো প্রচারযন্ত্র নেই। হরেন বাবুর প্রচারের দায়িত্ব নিলেন বিদ্যানগর কলেজেরই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তরুণ এক অধ্যাপক। নিয়মিত ক্লাস নেওয়ায় কোনো খামতি নেই, অথচ তার সঙ্গেই মাঠেঘাটে পড়ে থেকে প্রচারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সেই তরুণ অধ্যাপকের নিষ্ঠায় মুগ্ধ হয়েছিলেন স্বয়ং অজয় মুখোপাধ্যায়ও। নির্বাচনে হরেনবাবু জয়ী হলেন। বাংলা কংগ্রেস অবশ্য একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল না। বামপন্থী দলগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়ে তৈরি হল যুক্তফ্রন্ট সরকার। মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়।

বিদ্যানগর কলেজের সেই তরুণ অধ্যাপকটি আর কেউ নন, প্রণব মুখোপাধ্যায়। যাঁর নামের বিশেষণ দিতে গেলে বহুবার ভাবনাচিন্তা করেও সঠিক কোনো কথা মাথায় আসে না। দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি? সফলতম অর্থমন্ত্রী? নাকি বাংলা রাজনীতির কিংবদন্তি? অথবা এই সমস্ত বিশেষণ একসঙ্গেও মানুষটির পুরো পরিচয় দিতে পারে না। সেই ১৯৬৭ সালে ৩২ বছর বয়সে রাজনীতির জীবনে প্রবেশ। বেশ দেরি করেই কেরিয়ার শুরু করেছিলেন। পরিবারে অবশ্য রাজনীতির আবহাওয়া ছিল। বাবা কামদাকিঙ্কর ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ের কংগ্রেস নেতা। জেলা কংগ্রেস সভাপতি, এআইসিসি সদস্য এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদেরও সদস্য হিসাবে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। তবে প্রণব মুখোপাধ্যায় বরাবর পড়াশোনা নিয়েই থাকতে ভালোবাসতেন। যদিও সামাজিক নানা ঘটনার থেকে দূরে সরে থাকতেন না। ‘দেশের ডাক’ নামে একটি স্থানীয় পত্রিকায় সাংবাদিকের কাজও করেছেন। এই সময়েই আলাপ শুভ্রাদেবীর সঙ্গে। ১৯৫৭ সালে তাঁদের বিয়ের সময় প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পরিবারের তরফ থেকে আপত্তি উঠেছিল। কারণ শুভ্রাদেবী ব্রাহ্মণ পরিবারের ছিলেন না। কিন্তু প্রণব তাতে পাত্তা দেননি। নিজের জীবনসঙ্গীনীকে তিনি চিনেছিলেন ঠিকই।

১৯৬৩ সালে বিদ্যানগর কলেজে অধ্যাপক হয়ে আসেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। সুন্দরবনের এই প্রত্যন্ত গ্রামটি বেশ পছন্দ হয়ে গিয়েছিল মুখোপাধ্যায় দম্পতির। সেখানেই থাকার পরিকল্পনা করেছিলেন। জমিও কিনে নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বাড়ি তৈরি সম্ভব হয়নি। কারণ রাজনিতিতে প্রবেশের পরেই তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল এক লম্বা সফর। ১৯৬৯-এর লোকসভা নির্বাচনে প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণমেননের প্রচারের দায়িত্ব পড়ে তাঁর উপর। তিনি বাংলা কংগ্রেস সমর্থিত নির্দল প্রার্থী। সেই প্রচারেও সাফল্য পেলেন প্রণব। পরপর এই দুই সাফল্যের খবর পৌঁছল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির কাছেও। বাংলা কংগ্রেস ততদিনে আবার জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে মিলেমিশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

১৯৬৯ সালে জাতীয় রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ প্রণব মুখোপাধ্যায়ের। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে রাজ্যসভার সাংসদ হিসাবে পার্লামেন্টে পাঠালেন। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি। ১৯৭১ সালে প্যারিস ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সভায় যে ভারতীয় প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের স্বাধীনতার হয়ে সওয়াল করেছিল, ৩৬ বছরের প্রণব সেই দলে ছিলেন। তখনও অবশ্য বাংলা কংগ্রেস মুছে যায়নি। এবং প্রণব মুখোপাধ্যায়ও আছেন বাংলা কংগ্রেসেই। ১৯৭৩ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগেই দুই দল মিলেমিশে গেল। আর সেই সময় কংগ্রেস থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়ে প্রথম লোকসভায় পা রাখলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। প্রথমবারেই পেলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দায়িত্ব। ১৯৭৫ সালে আবার রাজ্যসভায় টিকিট পেলেন তিনি।

আরও পড়ুন
শেষ হল লড়াই, চলে গেলেন ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়

দেখতে দেখতে এসে গেল ১৯৭৭ সাল। নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রবল ভরাডুবি। দলের মধ্যেও উঠেছে ইন্দিরা হঠাও স্লোগান। এমার্জেন্সির সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল, আর তার প্রয়োগ ঘটেছে আরও ভুলভাবে; সেকথা স্পষ্টই বুঝতে পারছেন সকলে। কিন্তু সমস্ত দায় ইন্দিরা গান্ধীর উপর চাপিয়েই নিষ্কৃতি পেতে চেয়েছেন সকলে। প্রণব মুখোপাধ্যায় কিন্তু পারেননি নেত্রীর পাশ থেকে সরে যেতে। আর এই আনুগত্যের কৃতজ্ঞতাও পেয়েছিলেন ইন্দিরার কাছ থেকে।

তবে ইন্দিরার মৃত্যুর পর দলের মধ্যে বেশ কোণঠাসা হয়ে পড়েন প্রণব মুখোপাধ্যায়। রাজীব গান্ধী তাঁকে খুব একটা পছন্দ করেননি। ১৯৮৬ সালে দল থেকে বহিষ্কৃত হলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে তৈরি করলেন নতুন একটি রাজনৈতিক দল, ‘রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস’। ৩ বছর টিকে ছিল এই দলটি। পরে ১৯৮৯ সালে আবার জাতীয় কংগ্রেসে ফিরে আসেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। এরপর যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি।  ১৯৯১ থেকে ’৯৬ টানা এই পদে থেকেছেন। ১৯৯৫-৯৬ সালে নরসিংহ রাওয়ের মন্ত্রীসভার বিদেশ্মন্ত্রী ছিলেন।

আরও পড়ুন
করোনায় আক্রান্ত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, রয়েছেন আইসোলেশনে

২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে আবার কংগ্রেসের প্রত্যাবর্তনের সময় প্রথমেই প্রধানমন্ত্রী হিসাবে উঠেছিল সোনিয়া গান্ধীর নাম। কিন্তু নানা জটিলতার মধ্যে সেটা সম্ভব না হওয়ায় দ্বিতীয় নামটা সবাই আশা করেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়ের। কিন্তু বাস্তবে তা আর হল না। প্রধানমন্ত্রী পদে দেখা গেল মনমোহন সিং-কে। তাঁকেও একপ্রকার নিজের হাতেই তৈরি করেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাঁর মন্ত্রিত্বের সময়েই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন মনমোহন সিং। সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছিল সেদিন থেকেই। এর পর দুবারের ইউপিএ সরকারে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক, বিদেশ মন্ত্রক এবং অর্থমন্ত্রকের দায়িত্বে দেখা গিয়েছে তাঁকে।

এর আগে ইন্দিরা জমানায় ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। তখন ইউরোম্যাগাজিনের তালিকায় বিশ্বের সেরা অর্থমন্ত্রীর স্বীকৃতি পেয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তখন কিন্তু ভারত উদার অর্থনীতির স্রোতে গা ভাসায়নি। সমস্তটাই ছিল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। আবার ২০০৯ সালে যখন তিনি মন্ত্রকের দায়িত্ব নিলেন, তখন যে শুধু উদারীকরণ ঘটে গিয়েছে তাই নয়; সমস্ত পৃথিবীর অর্থনীতি চরম মন্দার মুখে পড়েছে। এমনকি আমেরিকার ওয়াল স্ট্রিটের পতনের কথাও আমরা জানি। এই ঘটনা যখন ঘটছে তখনও ভারতের অর্থমন্ত্রকের দায়িত্বে প্রণব মুখোপাধ্যায়। কিন্তু শক্ত হাতে দেশের অর্থনীতির হাল ধরে রেখেছেন তিনি। দেশের সফলতম অর্থমন্ত্রীই শুধু নন, লোকসভায় ৭টি বাজেট পেশ করার রেকর্ডও অন্য কোনো অর্থমন্ত্রীর নেই। পাশাপাশি আরও দুটি মন্ত্রিসভা শক্ত হাতে সামলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন তিনি। সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলতেন, ‘ভারতের না-পাওয়া শ্রেষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী’ ছিলেন তিনিই। অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রী হলে, স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে তাঁর তুলনীয় আর ছিল না কেউই...

সমস্ত জীবন কাজ পাগল মানুষ ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাঁর মেয়ের কথায়, কোনো কোনো দিন ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ নিয়েই থাকতেন তিনি। ছুটি নেওয়ার কথা তাঁর মনে হত না। বাঙালির আলস্য যে তাকে অসফল করে না, সেটাই জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গিয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। এমনকি ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে থাকাকালীনও সমস্তদিকে নজর রেখে গিয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। একদিকে ইউপিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, আর তারপর বিজেপির নরেন্দ্র মোদী – দুজনেরই মাথার উপর ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। কখনও এই নিয়ে কোনো জটিলতা তৈরি হয়নি। 

প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বর্ণময় জীবনের প্রথম অধ্যায়ের খুঁটিনাটি আর জানা না গেলেও শেষ ৪০ বছর তিনি নিয়মিত ডায়রি লিখেছেন। আর খুব তাড়াতাড়ি সেই ডাইরি প্রকাশিত হতে পারে। তাঁর নিজের জবানিতেই তখন জানা যাবে আরও অনেক ঘটনার কথা। বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রাম মিরাটি থেকে রাইসিনা যাত্রার লম্বা সফর হয়তো অজানাই থেকে যাবে অনেকটা। কিন্তু জাতীয় রাজনীতির মঞ্চেও অনেক লড়াই করে নিজের জায়গা টিকিয়ে রাখতে হয়েছে এই বাঙালিকে। সেই কাহিনি প্রত্যেক বাঙালির কাছে এক অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে।

Powered by Froala Editor

More From Author See More