হলুদ রং, হাসিমুখ ও ‘এনার্জি সিক্রেট’ – স্মাইলির জন্ম ও বিশ্বজয়ের ইতিহাস

গল্প করতে, আড্ডা মারতে কে না পছন্দ করে। মনের মতো সঙ্গী, বন্ধুরা থাকলে সময়ের কোনো ঠিকানা থাকে না। এখন তো আবার ডিজিটাল যুগ। আর এই সময় ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় সবাই নিজেদের প্রিয়জনদের সঙ্গে আড্ডা জমান। এই লকডাউনের বাজারে তার পরিমাণ স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু এই মেসেজ করার সময় আমরা কি শুধু কথাই বলি? মানে, শুধু অক্ষরই কি সাজানো থাকে স্ক্রিনে? তা তো না। মাঝে মাঝেই হলুদ রঙের ছোটো ছোটো কিছু মুখ ভেসে আসে। আমরা সেটা দেখে বুঝেও যাই অপর মানুষটির মনের ভাব। চিনতে পারলেন সেই হলুদ মুখগুলোকে? হ্যাঁ, স্মাইলি; যার আরও একটা নাম ‘ইমোজি’। কখনও হাসি, কখনও রাগ, দুঃখ— সবকিছু প্রকাশ করার শর্টকাট মাধ্যম এটি। বলা যায়, আমাদের সুখ দুঃখের সাথী হয়ে গেছে এরা।

কবে এই ‘হাসির’ সূত্রপাত? খানিক পেছনে ফেরা যাক। ১৯৬৩ সালের কথা। আমেরিকার ম্যাসাচুশেটসের এক গ্রাফিক ডিজাইনার, হার্ভে বলের কাছে এক অদ্ভুত কাজের অফার আসে। স্টেট মিউচুয়াল লাইফ অ্যাসুওরেন্স কোম্পানির তরফ থেকে বলা হয়, তাঁদের কর্মীদের জন্য এমন কিছু ডিজাইন করা হোক, যা প্রতিদিন তাঁদের বুস্ট আপ করবে। সেটাই হবে তাঁদের ‘এনার্জির সিক্রেট’। যাই হোক, এবার সমস্যা, কী এমন জিনিস আঁকা হবে যা দিয়ে এমন কাজটি করা সম্ভব হবে? হার্ভে একটু ভাবলেন। হাতের সামনে ছিল একটি হলুদ কাগজ। ব্যস, আইডিয়া চলে এল! ওই কাগজেই একটি বৃত্ত আঁকলেন, আর তার ভেতরেই আঁকলেন একটি হাসিমুখ। বাকিটা, ইতিহাস… 

’৬৩ সালের ওইদিন থেকেই শুরু হল স্মাইলি’র জয়যাত্রা। ক্লাসিক ফিগার হয়ে দাঁড়াল ওই হলুদ হাসিখুশি মুখটি। কিন্তু হলুদ কাগজই কেন? হার্ভের যুক্তি ছিল, এই রংটি সূর্য, সূর্যালোককে নির্দেশ করে। অর্থাৎ, দিনের শুরুটা যেন এরকমই উজ্জ্বল, সুন্দর একটা হাসি দিয়ে শুরু করা যায়, তাহলে সেটাই ভালো। সেটা ওই কোম্পানি নিল তো বোটে, বদলে হার্ভে বল পেলেন মাত্র ৪৫ ডলার! 

কিন্তু যেটা শুরু করার কথা ছিল, সেটা করে দিয়ে গিয়েছিলেন হার্ভে। ধীরে ধীরে এই ‘স্মাইলি’ই গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। ৭০-এর দশকে স্পেনে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করা হয় স্মাইলির সাহায্যে। সঙ্গে জুড়ে যায় ক্যাচলাইন ‘হ্যাভ আ হ্যাপি ডে’। আসল সময় আসে ফ্রান্সে; যখন ফ্রেঞ্চ জার্নালিস্ট ফ্রাঙ্কলিন লুফ্রানি প্রথম চালু করলেন একটি কোম্পানি, নাম ‘দ্য স্মাইলি কোম্পানি’। কালে কালে এটাই গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। স্মাইলির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে গেল। আর আজ? নিশ্চয়ই বলতে হবে না। আমেরিকার কালচারের সঙ্গেও জুড়ে যায় এটি। ‘নিরভানা’, ‘দ্য টকিং হেডস’-এর মতো ব্যান্ডও নিজের মতো করে একে আপন করে নেয়।

প্রথম প্রথম একটা স্মাইলি থাকলেও, পরে এর বৈচিত্র্য বাড়তে থাকে। মানুষের নানা ভাব, ভঙ্গি, অভিব্যক্তিকে ধরতে থাকে এই স্মাইলি। কখনও হাসি, কখনও রাগ, কখনও অট্টহাসি। কিছু না বলেও, নিজের মনের ভাব প্রকাশ করার এই রাস্তাই আকৃষ্ট করে সবাইকে। নিছক আইকন নয়, স্মাইলি হয়ে ওঠে একটা যুগ, একটা জগত। যে জগতে কোনো কথা নেই, তাও কত কিছু বলে দেওয়া হচ্ছে গোপনে। রবি ঠাকুরের ভাষায়, ‘গোপন কথাটি রবে না গোপনে’…

এরপর এল লেখার বার্তা। ইমোজি আসার আগেই মেসেজে, বা এমনি লেখায় চিহ্নের মাধ্যমে স্মাইলির ব্যবহার বাড়তে থাকে। শুরুটা করেছিলেন স্কট ফাহলম্যান। ১৯৮২ সালে এই অধ্যাপক একটি ইলেকট্রনিক বার্তা প্রদান করেন। যেখানে প্রথমবার চিহ্নের মাধ্যমে স্মাইলিকে ধরা হয়। তখন থেকেই কোলন, ড্যাশ, ব্র্যাকেট ব্যবহার করে এর প্রচলন শুরু। তারপর এল আধুনিক সময়। প্রযুক্তির মহাবিস্ফোরণের অন্যতম কারিগর হয় স্টিভ জোবসের ‘অ্যাপল’ কোম্পানি। ২০১২ সালে তাঁরা তাঁদের মোবাইলে প্রথমবার নিয়ে আসেন স্মাইলি। এখান থেকে যাত্রা শুরু আরেকটা নামের, ‘ইমোজি’, বা ইমোটিকন। 

আরও পড়ুন
চাঁদের জন্ম কীভাবে? প্রচলিত ধারণা বদলে দিল সুপার কম্পিউটার

আবারও একটা ইতিহাস। পরের বছরই, ২০১৩ সালে এই ইমোজি শব্দটি জায়গা করে নেয় অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে। ২০১৪ সালে টুইটার প্রথমবার সোশ্যাল মিডিয়ায় ইমোজির ব্যবহার শুরু করে। তারপর যত সময় এগিয়েছে, এর বৈচিত্র্য আরও আরও বেড়েছে। স্মাইলি থেকে ইমোজি— এই গোটা যাত্রাপথটি বড়োই মধুর। এখনও শেষ হয়নি সেই রাস্তা। আমরা চলছি এখনও। শুধু একবার অন্তত মনে করে নেওয়া হার্ভে বলকে, যিনি না থাকলে এই গোটা ব্যাপারটাই ঘটত না। ছোট্ট একটি জিনিস, অথচ তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে হাজার বিস্ময়! 

Powered by Froala Editor