বিশ্বের প্রাচীনতম ট্যাটু পার্লার, বয়স প্রায় ৭০০ বছর

দোকানের সদর দরজার ওপরে ঝোলানো কাঠের সাইনবোর্ড। তার ওপর নীল রঙে লেখা রয়েছে ‘রাজওউক ট্যাটু, ট্যাটু উইথ হেরিটেজ সিনস ১৩০০’। এই সাইনবোর্ড দেখে চমকে উঠতে হয় যে-কাউকেই। হ্যাঁ, ৭০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সচল রয়েছে এই আশ্চর্য ট্যাটু পার্লারটি। ২০২২ সালে গিনেস বুকও ‘বিশ্বের প্রাচীনতম ট্যাটু শপ’-এর তকমা দিয়েছে জেরুজালেমের ওল্ড সিটিতে অবস্থিত এই দোকানটিকে। 

জেরুজালেমের এই ট্যাটু পার্লারে ঢুকলেই চোখে পড়বে সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো গিনেস বুকের শংসাপত্র। তবে সেদিকে না-তাকিয়েও দিব্যি আন্দাজ পাওয়া যায় এই ট্যাটু শপের বয়স সম্পর্কে। সেখানে আজও ট্যাটু তৈরি করার জন্য ব্যবহৃত হয় প্রায় ৪০০-৫০০ বছরের প্রাচীন কাঠের ছাপ, হলুদ হয়ে উঠেছে কয়েকশো বছরের প্রাচীন নকশা গ্রন্থের পাতা। তাছাড়া দেওয়ালে চোখ রাখলেই দেখা যাবে সাতাশ পুরুষের ছবি। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন সাতাশ পুরুষ। ‘রাজওউক ট্যাটু’-র বর্তমান মালিক ওয়াশিম ২৮তম প্রজন্মের প্রতিনিধি। সেখানে থেকেই স্পষ্ট আন্দাজ পাওয়া সম্ভব এই দোকানের বয়স কত। তবে মজার বিষয় হল, বর্তমানে এই দোকান ইজরায়েলে অবস্থিত হলেও, প্রথম ‘রাজওউক ট্যাটু’-র ব্যবসা শুরু হয়েছিল মিশরে। 

ত্রয়োদশ শতকের শেষ দিক থেকেই মিশরে শুরু হয় খ্রিস্ট এবং ইসলাম ধর্মের সংঘাত। সে-সময় খ্রিস্টানরা একে-অপরকেও সন্দেহের চোখে দেখতেন, পাছে যদি কোনো ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ খ্রিস্টান সেজে ঢুকে পড়ে গির্জায়। এই সমস্যার সমাধান করতেই ট্যাটু করার চল শুরু হয় কোপ্টিক খ্রিস্টান পরিবারে। অবশ্য তখনও পর্যন্ত ‘ট্যাটু’ কথাটির প্রচলন হয়েছিল কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। মূলত হাতের কব্জির ওপর ক্রুশের ছবির উল্কি আঁকা হত জৈব কালি দিয়ে। এই উল্কি দেখালে তবেই প্রবেশাধিকার দেওয়া হত গির্জায়। ফলে, ট্যাটুর চাহিদা ছিল তুঙ্গে।

সে-সময় রাজওউক পরিবারের এক সদস্য ইয়াকুব শুরু করেছিলেন এই ব্যবসা। অবশ্য এটিই একমাত্র দোকান ছিল না। সে-যুগে মিশরের অলিতে-গলিতে গজিয়ে উঠেছিল আরও বহু ট্যাটু পার্লার। তবে খুব বেশিদিন ব্যবসা ধরে রাখতে পারেনি কেউ-ই। অন্যদিকে ট্যাটুকে আকর্ষণীয় করে তুলতে রাজওউক পরিবার নিত্যনতুন নকশা তৈরি করে থাকে। যেগুলি ক্রমে জনপ্রিয়তাও পায় স্থানীয়দের মধ্যে। প্রতিরক্ষা ও শনাক্তকরণের চিহ্নই হয়ে ওঠে খ্রিস্টানদের গর্বের প্রতীক। স্থানীয় মিশরীয়রা তো বটেই, মিশরে আগত ইউরোপীয় ও এশীয় পর্যটক ও তীর্যযাত্রীরাও ট্যাটু করাতেন এই দোকানে। 

অবশ্য এই দোকান বন্ধ হয়ে যায় আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে। ব্যবসা বন্ধ করে সপরিবারে পবিত্রভূমি ইজরায়েলে তীর্থ করতে পাড়ি দিয়েছিলেন ওয়াশিমের পূর্বপুরুষরা। তারপর সেখানেই নতুন করে বসতি স্থাপন করে রেজওউক পরিবার। মিশরে ফেরা হয়নি আর। তবে পুরনো পেশাকেই আঁকড়ে থাকেন তাঁরা। জেরুজালেমের বুকে ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়ে খোলেন ট্যাটু পার্লার। যা আজও অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ওল্ড সিটিতে। হয়ে উঠেছে ইতিহাসের এক জীবন্ত অধ্যায়। 

একটা সময় কেবলমাত্র জৈব কালির ব্যবহারে শরীরে সূচ ফুটিয়ে ট্যাটু করা হত এই দোকানে। আজ প্রযুক্তির দৌলতে বদলেছে ট্যাটু করার পদ্ধতি। এসে গেছে অত্যাধুনিক বৈদ্যুতিক যন্ত্র। তবে কেউ চাইলে এই দোকানে এখনও ট্যাটু করাতে পারেন সেই শতাব্দীপ্রাচীন পদ্ধতিতে। আধুনিক নকশার সঙ্গে রয়েছে ৫০০-৬০০ বছরের পুরনো নকশার বাহারও। পাওয়া যায় প্রাচীন ব্যক্তিত্বদের স্বাক্ষর এবং প্রাচীন মিশরীয় হায়ারোগ্লিফে লেখা বিভিন্ন প্রবাদবাক্য। 

মজার বিষয় হল, হিব্রু বাইবেল অনুযায়ী শরীরে ট্যাটু করা পাপ। বহু ইজরায়েলি খ্রিস্টান এবং ইহুদিই বিশ্বাসী এই ধারণায়। আবার ইসলাম ধর্মেও ট্যাটুকে দেখা হয় খারাপ নজরে। নাস্তিকদের বাদ দিলে, ওয়াশিম রাজওউকের অধিকাংশ উপভোক্তাই কিন্তু এই তিন গোত্রের মানুষ। শুধুমাত্র প্রাচীনতা এবং ঐতিহ্যের টানেই তাঁরা ছুটে আসেন এই ৭০০ বছরের প্রাচীন দোকানে। নিজের শরীরকেও অংশ করে নেন এক জীবন্ত ইতিহাসের। সবমিলিয়ে এও এক আশ্চর্য জগতই বটে। 

Powered by Froala Editor