নির্ভয়া-কাণ্ডের পুনরাবৃত্তিতেও নিস্তরঙ্গ দেশ, 'স্বাভাবিক' হচ্ছে অপরাধও?

“যে কোনো ধর্ষণ, নারীর প্রতি নির্যাতন, যৌন আক্রমণ— গোটাটাই তো রাজনীতি। পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোতে এটা একটা প্রচলিত উপায় যেখানে মহিলা দের ওপরে শক্তি এবং ক্ষমতা প্রদর্শন করা যায়। মনে রাখতে হবে ধর্ষণের সাথে যৌন তৃপ্তি বা তুষ্টির কোন সম্পর্ক নেই। এটা পুরুষের নারী শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণের উপায়। আমরা ভেবেছিলাম, নির্ভয়ার পর আইন বদল হলে এই ধরনের ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু তারপরেও আমরা হাথরাস, সাকিনাকা (Sakinaka) দেখেছি। তাহলে আইন বদল করেও মহিলাদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে কেন কোনো সুবিধে হচ্ছে না? এ দায় কার?”

বলছিলেন মানসিক স্বাস্থ্য অধিকারকর্মী রত্নাবলী রায়। প্রসঙ্গ, মুম্বাইয়ের (Mumbai) আন্ধেরির সাকিনাকা অঞ্চলে ঘটে যাওয়া নৃশংস ধর্ষণ কাণ্ড (Rape Case)। ধর্ষণের পরে যৌনাঙ্গে রড ঢুকিয়ে দেওয়ার পাশবিক এই ঘটনা যেন ফিরিয়ে দিচ্ছে নির্ভয়াকাণ্ডের স্মৃতি (Nirbhaya Case)। হাসপাতালে প্রায় ৩৩ ঘণ্টা লড়াই চলার পর গতকাল মৃত্যু হল ৩২ বছরের নির্যাতিত। অথচ, নৃশংস এই ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরেও যেন নিস্তরঙ্গ গোটা দেশ। এমন একটি ঘটনায় সেইভাবে কি গুরুত্ব দিয়েছে সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমও? 

পিছিয়ে যাওয়া যাক কয়েক ঘণ্টা। শুক্রবার সকালেই সাকিনাকার খায়রানির অঞ্চলে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল নির্যাতিতার দেহ। খবর পাওয়ার পরই মুম্বাই পুলিশের একটি দল দ্রুত পৌঁছায় ঘটনাস্থলে। স্থানীয় রাজওয়াড়ি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় মহিলাকে। ঘটনাটি যে পরিষ্কার ধর্ষণকাণ্ড, তা শুক্রবার সকালেই স্পষ্ট করে জানিয়েছিল মুম্বাই প্রশাসন। কিন্তু ভারতের প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমগুলিতে সেসময় প্রায় উপেক্ষিত হয়েছিল এই ঘটনা। পরবর্তীতে নির্যাতিতার মৃত্যুর পর সামনে আসে বর্বরোচিত ঘটনার বিবরণ।

দায়বদ্ধতার এই অভাবই তুলে আনছে একাধিক প্রশ্ন। তবে কি প্রতিটি ধর্ষণকাণ্ডকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না আমাদের সমাজে? তার সঙ্গে কি জড়িয়ে যাচ্ছে রাজনীতি, প্রাদেশিকতাও? এই জায়গাটিতেই আলোকপাত করছিলেন সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়। তবে শুধু রাজনীতিই নয়, এর সঙ্গে যেন জড়িয়ে রয়েছে সমাজের মনস্তত্ত্বের একটি অন্ধকার অধ্যায়ও। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের পরেও এমন একটি ঘটনা সম্পর্কে আমরা নিজেরাও বা কতটা সরব হয়ে পেরেছি? নাকি অনবরত ঘটতে থাকা এমন নৃশংসতার সঙ্গে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি আমরা?

আরও পড়ুন
৬০ বছর আগে ধর্ষণ ও খুন, অপরাধীর পরিচয় খুঁজে দিল জিন টেকনোলজি!

মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন তুললেন সেই জায়গাটাতেই, “নির্ভয়া কাণ্ডের পর আমরা যে পরিমাণ প্রতিবাদ মিছিল, জনমত গঠন দেখতে পাচ্ছিলাম, এক্ষেত্রে সত্যিই পাচ্ছি না। এবং সেখানে আমার নিজের মনে হচ্ছে, এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি তাহলে কি আমাদের মধ্যে ততটা অভিঘাত তৈরি করছে না? আমরা কি তাহলে মানসিক অসাড়তার মধ্যে চলে যাচ্ছি যেখানে নৃশংসতা ঘটলেও সেটা আমাদের আর ততটা বিঁধছে না? এটা আমার কাছে একটা আশঙ্কার জায়গা। আমি মনে করি এটা আমাদের নিজেদের মধ্যে একটু রিফ্লেক্ট করে দেখার দরকার আছে। কারণ প্রতিবাদ, সুরক্ষার দাবি, ঝড় যত উঠবে, এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির রাস্তা তত অমসৃণ হবে। সুতরাং এখানে আমাদের একটা দায়িত্ব বর্তায় বৈকি। অনেক ধরনের নারী অত্যাচার, হিংসার ঘটনা যখন বারংবার ঘটতে থাকে তখন কোথাও যেন সেটাই তো প্রায় স্বাভাবিক— এইরকম একটা মনোভঙ্গি চলে আসতে পারে। যেটির সম্পর্কে আমাদের আলাদা করে সচেতন হওয়ার প্রয়োজন আছে। এই মানসিকতা আমাদের প্রতিবাদের পথকে দুরূহ করে তোলে এবং এই ধরনের ঘটনা আরও ঘটে চলার পথকে আরও মসৃণ করতে থাকে। একটা বিরাট বড়ো অন্যায় স্ট্যাটিস্টিক্যালি বার বার ঘটলেই কিন্তু সেটাই ঘটবে, আমরা এমন যেন ধরে না নিই। ঘটনার সংখ্যাগরিষ্ঠতা মানে সে ঘটনাকে আমরা যেন স্বাভাবিক ধরে না নিই।”

আরও পড়ুন
মহিলাদের অশালীনতাই ধর্ষণের কারণ, মন্তব্য ইমরান খানের

কিন্তু পারতপক্ষে যে সেই স্বাভাবিকীকরণের দিকেই আমরা এগিয়ে চলেছি ক্রমশ, তা স্পষ্ট মুম্বাইয়ের পুলিশ কমিশনার হেমন্ত নাগরালের মন্তব্যেও। আজই বাণিজ্যনগরীর অন্যতম প্রশাসনিক প্রধান জানিয়েছেন, পুলিশের পক্ষেও প্রতিটি অপরাধের ঘটনায় উপস্থিত থাকা সম্ভব নয়। তাঁর এই বক্তব্য শুধু দুঃখজনকই নয়, বরং তা যেন ঘটতে থাকা এই নৃশংসতার কাছে পরোক্ষ নতিস্বীকার। স্বাভাবিকতার তকমা দেওয়া ধর্ষণকাণ্ডকে। 

আরও পড়ুন
উত্তরপ্রদেশে প্রতি ৩ ঘণ্টায় একটি ধর্ষণ, বাংলার নারী-সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন আদিত্যনাথ!

“এক ধরনের স্বাভাবিকীকরণের প্রবণতা আমরা দেখছি। মহিলারা বাইরে বেরলে ধর্ষিত হবেন, নির্যাতিত হবেন— এই চিন্তার একটা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদত আমরা দেখছি”, জানালেন রত্নাবলী রায়। এসবের বাইরে এই স্বাভাবিকীকরণকে বৃহত্তর পরিসরে দেখলে আসতে বাধ্য ভাষার প্রসঙ্গও। শুধু মানসিক চিন্তাধারাই নয়, আমরা নিজেরাও যেন কখনো কখনো অজান্তেই ‘সায়’ দিয়ে ফেলছি এই বর্বরতাকে। রত্নাবলী যোগ করলেন, “সেইসঙ্গে আমরা যে ভাষা ব্যবহার করি সেই ভাষাও গোলমেলে। নির্ভয়া কাণ্ডে বলা হয়েছিল, এটা ‘রেয়ারেস্ট অফ রেয়ার’ ক্রাইম। অপরাধের আবার রকমফের কী? যে মুহূর্তে আমি গুরুতর অপরাধ ও লঘুতর অপরাধের বিভেদ করছি, সেই মুহূর্তেই আমরা বিষয়টাকে ট্রিভিয়ালাইজ করার সংস্কৃতি তৈরি করছি। প্রত্যেকটি নির্যাতন ও হিংসার ঘটনা একই গুরুত্ব দিয়ে অ্যাড্রেস করতে হবে যাতে সমাজে ভুল বার্তা না যায়। তৃতীয়ত, আমাদের দেশে রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে প্রতিবাদ করার ধরন পাল্টে যাচ্ছে। প্রতিবাদ করার পরিসর ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে, বাধা এসে দাঁড়াচ্ছে, যেমন এখন অতিমারি। নারী সুরক্ষার প্রশ্নে প্রশাসনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্যের পুলিশ প্রশাসন এর উচিত নারীদের উপর ঘটে যাওয়া যে কোনো ঘটনাকে শক্ত হাতে দমন করা, বরদাস্ত না করা।”

কিন্তু আইন-আদালত, প্রশাসন দিয়েই কি একদিনে বদল আনা সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর যে নেতিবাচক, তাঁর প্রত্যক্ষ প্রমাণ সাকিনাকার ঘটনা। নির্ভয়া কাণ্ডের পর একাধিক আইনি বদল, শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে পকসো আইন প্রবর্তনের পরেও এতটুকু বদলায়নি বাস্তব পরিস্থিতি। বরং, হিংস্রতার প্রাবল্য বেড়েছে আরও। এমন একটা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে যেন আরও প্রকট হয়ে উঠছে, বদল দরকার শিক্ষা ব্যবস্থার পরিকাঠামোয়। প্রাথমিক স্তর থেকে সচেতনতা গড়ে তোলাই বোধহয় একমাত্র রাস্তা। তবে স্কুলস্তরের আগে, গোটা সমাজের মধ্যেই এই সচেতনতা বৃদ্ধির দায় নিতে হবে সরকারকে। রত্নাবলীর কথায় মিলল সেই ইঙ্গিত, “যে মুহূর্ত থেকে আমরা কোনো শিশুকে কন্যা সন্তান বা পুত্র সন্তান হিসাবে অভিহিত করি, তখন থেকেই সমস্যার বীজ বপন করি। একজন সন্তানকে মানুষ হিসাবে বড়ো করলে, ক্ষমতার কাঠামোর ধারণা পাল্টাবে। স্কুল স্তর তো অনেক পরের প্রশ্ন, বাড়িতে আগে সেই সচেতনতার পাঠ শুরু করতে হবে।”

কিন্তু এত কিছুর পরেও প্রশ্ন থেকে যায়, সমাজকর্মীদের সরব হওয়ার পরেও কি আদৌ সেকথা পৌঁছাচ্ছে প্রশাসনের কানে? পৌঁছালেও কতটা হেলদোল পড়ছে প্রশাসনিক পদক্ষেপে? জানা নেই। শুধু এটুকুই আশা রাখার, প্রতিবাদ-জনমত গড়ে উঠলে হয়তো ধীর গতিতে বদলাবে পরিস্থিতি…

Powered by Froala Editor