বিদেশের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে জলাশয় সংস্কার তামিলনাড়ুর যুবকের

তিনি পেশায় ছিলেন সফটওয়্যার ডেভলপার। দুবাইয়ের একটি বড়ো সংস্থায় বিরাট মাইনের চাকরিতে দিব্যি চলে যাচ্ছিল জীবন। মাঝেমধ্যে ছুটিতে আসতেন জন্মভূমি তামিলনাড়ুতে, কিছুদিন থেকে আবার ফিরে যাওয়া বিদেশে। ২০১৮ সালের শেষদিকে এদেশে আসার সময়ও এরকমই পরিকল্পনা ছিল তাঁর। কিন্তু সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল সেবার। সাইক্লোন ‘গাজা’-র আবির্ভাবে ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গোটা তামিলনাড়ু (Tamilnadu)। আর সেই ঝড়কে জয়ধ্বজা করেই শুরু হল নিমল রাঘবনের (Nimal Raghavan) জীবনের নতুন গল্প।

থাইল্যান্ডের উপসাগরে তৈরি হওয়া ‘গাজা’ বঙ্গোপসাগরের পথ ধরে তামিলনাড়ুতে আছড়ে পড়ে ২০১৮-র ১১ নভেম্বর। ছ’টি জেলায় প্রবল তাণ্ডব চালিয়ে পুদুচ্চেরি হয়ে চলে যায় আরবসাগরের দিকে। মৃত্যু হয় প্রায় পঞ্চাশজন মানুষের। ঘরছাড়া এক লক্ষ মানুষ। ঝড়ের প্রভাবে ভেঙে পড়ে অসংখ্য গাছপালা, সার্বিকভাবে ব্যাহত হয় জনজীবন। যে জীবন চলে গেছে, তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে নতুন করে সাজিয়ে তোলা যায় প্রকৃতিকে। ছুটি কাটাতে ভারতে আসা নিমলও হাত লাগিয়েছিল উদ্ধারকার্যে। চার মাস ধরে তিনি লেগে রইলেন ত্রাণের কাজে। কিন্তু তাঁর চোখে পড়েছিল এক অন্য সমস্যার ইঙ্গিত। যা বেশ কয়েক বছর ধরেই বারবার বিপদে ফেলছে তামিলনাড়ুকে। আর শুধু সেই রাজ্য নয়, গোটা দেশই কমবেশি ধুঁকছে সেই সমস্যায়। তা হল জলসঙ্কট।

দুবাইয়ের বিরাট অঙ্কের চাকরি ছেড়ে দিলেন নিমল। ত্রাণকার্যে বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে এবং মানুষের সঙ্গে কথা বলে যে ভয়াবহ সমস্যার কথা জানতে পেরেছেন, তা যেন তাঁর চোখ খুলে দিয়েছে। বিপদ ছিল আগে থেকেই, ঝড়ের ফলে যা সম্পূর্ণভাবে উন্মুক্ত করেছে নিজেকে। বিদেশের ‘সুখী’ জীবন নয়, বরং দেশের মানুষ তথা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত রাখার জন্য শুরু হল তাঁর সংগ্রাম। কাবেরি নদীর ছোটো ছোটো বদ্বীপকে সজীব করে তোলাই ছিল তাঁর প্রাথমিক উদ্দেশ্য। চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলেন, আগে যেখানে বছরে তিনবার ফসল ফলাতেন তারা, এখন তা ঠেকেছে একবারে। মূলত জলের অভাবের জন্যই এই অবস্থা। নিমল সাহায্য নিলেন সমাজমাধ্যমের শুরু করলেন 'ফাইট ব্যাক ডেলটা'-র প্রচার, সেই সূত্রেই তৈরি হয়ে গেল যুবক-যুবতীদের একটি দল। অসহায় মানুষদের খাদ্য, পোশাক, আর্থিক সাহায্য দেওয়ার পাশাপাশি শুরু হল এক বড়ো পরিকল্পনা।

তাঁর নিজের গ্রাম নাদিয়াম-সহ আশেপাশের অঞ্চলের সবচেয়ে বড়ো হ্রদের নাম পেরাভুরানি। যদিও, তখন সেটির অবস্থা বেশ শোচনীয়। পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজন লোকবল, পরিকল্পনা, প্রযুক্তি এবং অবশ্যই অর্থ। নিমলের সদিচ্ছা ও সাংগঠনিক কুশলতায় একে একে পাওয়া গেল প্রতিটি সাহায্য। প্রায় ৩২ লক্ষ টাকা চাঁদা উঠল শুভানুধ্যায়ী মানুষদের থেকে। হাত লাগাল স্থানীয় লোকেরাও। যে হ্রদ ছিল দূষণে পরিপূর্ণ, চড়া পড়ে ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছিল যার আয়তন, তা যেন প্রাণ ফিরে পেল নিমল ও তাঁর দলের প্রচেষ্টায়। আসলে জীবন ফিরে পেল সাধারণ মানুষ। প্রায় ৬০০০ একর জমি ফের সারাবছরের জন্য চাষযোগ্য হয়ে উঠল পেরাভুরানি সংস্কারের ফলে। আর এই হ্রদের চারদিকে পোঁতা হল ২৫০০০ চারা গাছ। একদিন যারা মহীরূপ হয়ে নিরাপত্তা দেবে গোটা অঞ্চলটিকে। আর হাওয়ায় দোলানো প্রতিটি পাতায় ভেসে যাবে নিমলের কীর্তির গল্প।

আরও পড়ুন
বিপর্যস্ত সামুদ্রিক পরিবেশ, জনসচেতনতা গড়ে তুলতে সাঁতারই হাতিয়ার লুইসের

এখান থেকেই শুরু তাঁর নতুন জীবন। এবার নিজের এলাকার বাইরে পা রাখলেন তিনি। যোগাযোগ করতে শুরু করেন রাজ্যের বিভিন্ন কৃষক সংগঠনগুলির সঙ্গে। এগিয়ে আসে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও। প্রত্যেকেরই লক্ষ্য এক—তামিলনাড়ু ও মহারাষ্ট্রের জলাশয়গুলিকে সংস্কার করে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে তোলা। পরবর্তী পাঁচ বছরে নিমলের উদ্যোগে সংস্কার করা হয়েছে ১৬০টি জলাশয়। প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ সরাসরি উপকৃত হয়েছে তাঁর পরিকল্পনায়। বন্ধ্যা হয়ে পড়ে থাকা মাঠগুলিতে মাথা দুলিয়ে উঠেছে সোনালি ফসল। প্রকৃতি আর মানুষের মধ্যে যেন প্রতিদিন নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলছেন নিমল। এছাড়াও বৃষ্টির জল সংরক্ষণ, বৃক্ষরোপণ, জলদূষণ প্রতিরোধের কাজে এগিয়ে এসেছেন তিনি। 

আরও পড়ুন
ম্যাজিককে হাতিয়ার করেই পরিবেশ সচেতনতা তৈরির লড়াই ভারতীয় ম্যাজিশিয়ানদের

আর শুধু হাতে-কলমে কাজ নয়, নিয়মিত চলে সচেতনতা প্রচারের কাজ। তাঁর আন্তরিকতার জন্য অত্যন্ত সফল হয়েছে সেই পরিকল্পনা। ফলে তিনি যেন ছড়িয়ে আছেন সর্বত্র। হয়ে উঠেছেন আশার প্রতীক। অর্থের লোভ সংবরণ করে যিনি এসে দাঁড়িয়েছেন মানুষের পাশে। যে ঝড়ে ভেঙে গেছিল মানুষের ঘরবাড়ি, সেই ঝড়ই নবজন্ম দিয়েছিল নিমলকে। তিনি বিশ্বাস করেন একা নয়, সবাইকে হয়ে উঠতে হবে ‘নায়ক’, তবে জয়ী হওয়া যাবে এই লড়াইয়ে।

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More