নবদ্বীপে তখন নিমাই পণ্ডিতের জয়জয়কার, বিদায়ের আগে জড়িয়ে ধরলেন প্রত্যেক ছাত্রকে

পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকেরা ১৪৮৫ থেকে ১৬০৩ সাল - এই সময়টাকে "The Beginnig of the Modern Age" নামে চিহ্নিত করেছেন। ইউরোপে তখন 'Renaissance' বা নবজাগরণের শুভারম্ভ। বিদ্যাচর্চা ও সাহিত্যসাধনার তুঙ্গে উঠছে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। আর ঠিক সেই সময়ে, এই বঙ্গভূমির নবদ্বীপে (ইতিহাসবিদরা যাকে 'প্রাচ্যের অক্সফোর্ড' বলে চিহ্নিত করেছেন) আবির্ভাব ঘটল এক তরুণ বাঙালি অধ্যাপকের। বাঙালির চিন্তা, চেতনা, সংস্কৃতির মোড় ঘুরিয়ে দিলেন তিনি। তাঁর নাম বিশ্বম্ভর মিশ্র। লোকে তাঁকে বলে, 'নদের নিমাই'।

ইতিহাসবিদরা বলেন, ১০৬৩ সালে কোনো এক সেনবংশীয় নরপতির হাতে নবদ্বীপের প্রতিষ্ঠা। 'আইন-ই-আকবরি'-র সাক্ষ্যে, নবদ্বীপ ছিল শেষতম সেন-নৃপতি লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে, বদলেছে বঙ্গদেশের শাসক। কিন্তু, বিদ্যাচর্চার বাতিস্তম্ভ হয়ে স্বমহিমায় অটল থেকেছে নবদ্বীপ। 'চৈতন্যভাগবত' রচয়িতা বৃন্দাবন দাস ঠাকুর লিখেছেন (আদি ২), 

"সবে মহা অধ্যাপক করি গর্ব্ব ধরে। বালকেও ভট্টাচার্য্য সনে কক্ষা করে।। নানা দেশ হৈতে লোক নবদ্বীপে যায়। নবদ্বীপে পড়িলে সে বিদ্যারস পায়।। অতএব পড়ুয়ার নাহি সমুচ্চয়। লক্ষ কোটি অধ্যাপক নাহিক নিশ্চয়।।"

ব্যাকরণ, অলঙ্কার, ন্যায়, স্মৃতি, জ্যোতিষ, বেদান্ত, গীতা-ভাগবতাদি শাস্ত্র - সকল বিষয়েই নবদ্বীপের পণ্ডিতসমাজে নিত্য চর্চা চলত। এ হেন নবদ্বীপে পড়তে এসেছিলেন এক পূর্ববঙ্গীয় ছাত্র, তাঁর নাম জগন্নাথ মিশ্র। পঠনপাঠন সাঙ্গ করার পর, অধ্যাপক নীলাম্বর চক্রবর্তীর বড়ো মেয়ে শচী দেবীকে বিবাহ করে নবদ্বীপেই সংসার পাতলেন তিনি। জগন্নাথ ও শচীর ঘরেই জন্ম নিলেন, বাংলার যুগান্তরের কাণ্ডারী বিশ্বম্ভর, ওরফে নিমাই।

আরও পড়ুন
চৈতন্য এই ঘনকালো, হাত-পা কাটা জগন্নাথের বুকের ভিতরেই মিলিয়ে গিয়েছিলেন?

শুভ দিন দেখে মিশ্র নিমাইয়ের হাতে খড়ি দিলেন, শুরু হল বাল্যশিক্ষার পালা। মেধাবী নিমাই একবার দেখেই সব অক্ষর লিখতে পারে, কয়েকদিনের মধ্যেই সে সমস্ত যুক্তাক্ষরও আয়ত্ত করে ফেলল। তারপর 'রাম', 'কৃষ্ণ', 'মুরারি', 'মুকুন্দ', 'বনমালী' এইসব নাম লিখতে আরম্ভ করে সকলকে চমৎকৃত করে দিল সে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই নেমে এল পারিবারিক বিপর্যয়। অতি অল্প বয়সে সন্ন্যাস নিলেন নিমাইয়ের অগ্রজ বিশ্বরূপ। ক্ষুব্ধ জগন্নাথ নিমাইয়ের লেখাপড়া বন্ধ করে দিলেন। শচীর কোনও অনুরোধেই কর্ণপাত করলেন না তিনি। 

শিশু বিশ্বম্ভর বাবার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মুখে কিছু বলল না বটে, কিন্তু ঘরে-বাইরে দুষ্টুমির মাত্রা বাড়িয়ে দিল। জিনিসপত্র ভাঙা, রাত্রিবেলা দুই বন্ধু মিলে কম্বলে শরীর ঢেকে ষাঁড় সেজে প্রতিবেশীর কলাবাগান নষ্ট করে দেওয়া, ঠিক প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাওয়ার আগে লোকজনের ঘরের দরজা বাইরে থেকে এঁটে দেওয়া- নিমাইয়ের বিচিত্র রকম দুষ্টুমির আর অন্ত নেই! একদিন কালিঝুলি মাখা বর্জ্য হাঁড়ির স্তূপে গিয়ে বসল নিমাই। শচীর ভর্ৎসনা শুনে বালক স্পষ্ট ভাষায় বলল, পড়াশোনা করতে না দিলে তার ভালো-মন্দর জ্ঞানটা হবে কোত্থেকে? পাড়া-প্রতিবেশী নিমাইয়ের পক্ষ নিলেন, বললেন, 

আরও পড়ুন
চৈতন্যদেব নাম দিয়েছিলেন ‘নব-নীলাচল’, বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে শ্রীরামপুর

"যত্ন করি কেহ নিজ-বালক পড়ায়।
কত ভাগ্যে পড়িতে আপনে শিশু চায়।।
কোন শত্রু হেন বুদ্ধি দিল বা তোমারে।
ঘরে মূর্খ করি পুত্র রাখিবার তরে।।"

চাপে পড়ে সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হলেন জগন্নাথ। উপনয়নের পর নিমাই ভর্তি হল গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে। নিমাই অল্পদিনের মধ্যেই সেই পাঠশালার শ্রেষ্ঠ পড়ুয়ার স্থানটি অধিকার করল। সেই সঙ্গে তার দুষ্টুমিতে অন্য মাত্রা যোগ হল। মুরারি গুপ্ত, কমলাকান্ত, কৃষ্ণানন্দ প্রভৃতি তাবড় তাবড় পড়ুয়াদের ফাঁকি (সংস্কৃতে 'ফক্কিকা' বা লোক ঠকানোর প্রশ্ন, আধুনিক ভাষায় 'গুগলি' বললে সহজে বুঝবেন) জিজ্ঞাসা করে কুপোকাত করে দিতে লাগল নিমাই। স্বভাবত চঞ্চল নিমাই অন্য পণ্ডিতদের ছাত্র দেখলেই তার সঙ্গে কোন্দল করেন, বাকযুদ্ধের পর জল-ফেলাফেলি, বালি ছোঁড়াছুঁড়ি, মারপিট সবই চলতে থাকে। বিশ্বম্ভর এমনই তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান যে, সে পড়ুয়াদের চ্যালেঞ্জের জবাবে ব্যাকরণের সূত্র ব্যাখ্যা করে, নিজেই সেই ব্যাখ্যার বিরুদ্ধ যুক্তিগুলি বলে খণ্ডন করে, আবার সেই যুক্তিগুলির অসাড়তা দেখিয়ে নিজের ব্যাখ্যাকে পুনঃস্থাপন করে। নিমাইয়ের অসামান্য বিতর্ক-কৌশলে পড়ুয়ারা একেবারে হাঁ হয়ে যায়! 

আরও পড়ুন
চৈতন্যের পুরী যাত্রাও এই পথেই; যেভাবে স্রোত হারাল কলকাতার প্রধান নদী আদিগঙ্গা

সোৎসাহে বিদ্যাচর্চা করে পাণ্ডিত্য অর্জন করলেন নিমাই। মুকুন্দসঞ্জয় নামক এক ধনাঢ্য ব্যক্তির চণ্ডীমণ্ডপে ব্যাকরণের টোল খুলে ছাত্র পড়াতে আরম্ভ করলেন তরুণ অধ্যাপক। সেই সঙ্গে তাঁর বিদ্যার ঔদ্ধত্যও থেমে ছিল না একেবারেই। যে যা নিয়ে পড়াশোনা করে, তাকে সেই বিষয়ের তর্কেই হারিয়ে দিতেন নিমাই। অলঙ্কার নিয়ে কথা বলতে এসে হেরে যেতেন মুকুন্দ, ন্যায়শাস্ত্রে নিমাইয়ের ব্যুৎপত্তি দেখে হার মানতেন গদাধর। নিমাইয়ের আকাশছোঁয়া আত্মবিশ্বাস! ক্রমেই বেড়েই চলল নবীন অধ্যাপকের খ্যাতি, বেড়ে চলল ছাত্রসংখ্যা। সারা ভারত জয় করে আসা অহঙ্কৃত দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত কেশব কাশ্মীরীকে সহজেই পরাস্ত করলেন নিমাই, নবদ্বীপে তাঁর সম্মান তুঙ্গস্পর্শী হয়ে উঠল। পরাজিত তার্কিককে কিন্তু তিনি অসম্মান করলেন না, বরং তাঁর শিষ্যরা হাসাহাসির উপক্রম করলে কঠোরভাবে নিবারণ করলেন। পুঁথিগত পড়াশোনার পাশাপাশি নিমাই দেখালেন, তিনি আদর্শ ভদ্রলোক! 

কিছুদিনের জন্য শিষ্যদের সঙ্গে পূর্ববঙ্গে অধ্যাপনা করতে গেলেন নিমাই। সেখানকার পড়ুয়ারা হাতে চাঁদ পেল। নিমাই শুনলেন, "উদ্দেশে আমরা সবে তোমার টিপ্পনী। লই পড়ি পড়াই শুনহ দ্বিজমণি।।" নিমাইয়ের লেখা টিপ্পনী (ধরতে পারেন 'গাইডবুক') পূর্ববঙ্গে প্রচলিত, এখন স্বয়ং নিমাই উপস্থিত। দলে দলে পড়ুয়া এসে জুটল। নিজের অসামান্য শিক্ষণ-পদ্ধতিতে মাত্র ছয় মাসের কোর্সে তাদের বিদ্যাবান করে তুললেন বিশ্বম্ভর। শেষে সুবর্ণ, রজত, জলপাত্র, দিব্যাসন, সুরঙ্গ কম্বল প্রভৃতি বহুরকম ভালোবাসার ভেট স্বীকার করে, শিষ্যদের সঙ্গে নিয়ে স্বগৃহে ফিরলেন নিমাই। 

নিমাইয়ের পাণ্ডিত্য নিয়ে আরেকটি কিংবদন্তি নবদ্বীপে প্রচলিত। সখা রঘুনাথ একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন, নিমাইকে পড়ে শোনাচ্ছেন। নিমাইও একই বিষয়ে চর্চা করছিলেন, তিনিও নিজের লেখা পড়ে শোনালেন রঘুনাথকে। রঘুনাথ স্তম্ভিত, যে কথা বোঝাতে তিনি পাতার পর পাতা ব্যয় করেছেন, মাত্র কয়েকটি অমোঘ শব্দে সে কথা জলের মতো বুঝিয়ে দিয়েছেন বিশ্বম্ভর! লেখার বিস্তার নয়, লেখার কন্টেন্ট আর সংক্ষিপ্ত করে বলার ক্ষমতাই যে আসল, হাতে কলমে শেখালেন নিমাই। সেইসঙ্গে, রঘুনাথের বইটি যাতে বাণিজ্যসফল হয়, সেজন্য নিজের পাণ্ডুলিপি নির্দ্বিধায় গঙ্গায় বিসর্জন দিলেন তিনি! 

তবে, গয়া থেকে প্রত্যাগমনের পর আর বেশিদিন টোল চালাতে পারেননি নিমাই। কৃষ্ণপ্রেমের আবেশে তিনি তখন ভাবোন্মত্ত। অকপটে শিষ্যদের জানালেন, অন্য শিক্ষকের সন্ধান করে নাও। প্রিয় অধ্যাপককে অশ্রুজলে বিদায় জানালেন পড়ুয়ারা, এতদিনের ছাত্রদের প্রত্যেককে আলিঙ্গন করে আশীর্বাদ করলেন নিমাই। বললেন, "পড়িলাম শুনিলাম যত দিন ধরি। কৃষ্ণের কীর্তন কর পরিপূর্ণ করি।।" ছাত্রদের অনুরোধে হাতে তালি দিয়ে কেদার রাগে গান ধরলেন নিমাই, সমবেত সঙ্কীর্তনে মুখরিত হল নবদ্বীপের আকাশ-বাতাস। 

এই শুরু হল শ্রীচৈতন্যের ধর্মবিহার। তাঁর এই প্রেমের জোয়ারে ক্রমে ভেসে গেছে বঙ্গভূমি। সমাজ-ব্যবহার, বিদ্যাচর্চা, নন্দনতত্ত্ব, খাদ্যাভ্যাস, নৃত্যগীতাদি সংস্কৃতি - প্রতিটি যাপনপ্রণালীতে তিনি এনেছেন আমূল বিপ্লবের ঢেউ। সেই আনন্দতরঙ্গ ক্রমে ভারতভূমির গণ্ডি পেরিয়ে প্লাবিত করেছে সমগ্র বিশ্বকে।

এই সবকিছুর শুরু হয়েছিল নবদ্বীপের একটি চণ্ডীমণ্ডপে - যেখানে বসত ব্যাকরণ পড়ার আসর, নিমাই পণ্ডিতের টোল।

Powered by Froala Editor