‘নাইটিঙ্গেল অফ বেঙ্গল’, মারণ যক্ষ্মা ও একুশ বছরের একটি জীবন

কাশতে কাশতে ক্রমশ দম ফুরিয়ে আসছে মেয়েটির। কতই বা বয়স, মাত্র ২১! এত ছোটো বয়সে এমন পরিণতি আর দেখতে পারছেন না বাড়ির লোকেরা। এ কী হল বলো তো মেয়েটার! যে গলা দিয়ে একসময় সাত সুরের রামধনু বেরোত, যার গান শোনার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকত, আজ তাঁরই গলায় যক্ষ্মার বাসা! ঠোঁটে লেগে রয়েছে রক্ত। অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন মেয়েটি— উমা বসু। ওঁর ডাকনাম হাসি; কিন্তু জীবন থেকে সেই হাসিটাই চলে গেছে চিরকালের মতো। তাহলে কি থেমে যাবে ‘বাংলার বুলবুল’?

ভারত এক অদ্ভুত দেশ। এখানে কত প্রতিভা আসে, প্রতিষ্ঠিত হয়; আবার কত সবুজ পাতা অকালে ঝরেও যায়। কেউ খ্যাতির আবর্তে পড়ে যায়, কারোর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে জীবন। এই বাংলাও কি কম প্রতিভা প্রসব করেছে? উমা বসু সেই বিরল প্রতিভাদেরই একজন। ইতিহাস আজ তাঁকে সেভাবে মনে রাখেনি। জীবন তাঁর গলা থেকে সুর কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু একেবারেই কি মনে করা যায় না তাঁকে? দেখেছিলেন মাত্র ২১টি বসন্ত; কিন্তু এইটুকু সময়ই গোটা ভারতে শিখর স্পর্শ করেছিলেন তিনি। তাঁর গলা হয়ে উঠেছিল সরস্বতীর নিখাদ আস্তানা… 

১৯২১ সাল। ধরণীকুমার বসু কলকাতার প্রখ্যাত স্থপতি। তাঁর পরিবার রীতিমতো বিখ্যাত এই শহরে। তাঁর স্ত্রী প্রভা বসুর পরিবারও কম পরিচিত নয়। আর এই ঘরেই জন্ম নিলেন উমা বসু (হাসি)। ধরণী-প্রভার বড়ো সন্তান। কিন্তু বেশিদিন সঙ্গ দিতে পারলেন না বাবা। দুর্ঘটনায় অসময়ই প্রয়াত হন ধরণীকুমার। কিন্তু উমার বেড়ে ওঠা থামেনি। আর থামবেই বা কেন! ‘হাসি’র জীবনে যে ততদিনে জুড়ে গেছে সুর! মেয়ের এমন প্রতিভার কি আঁচ পেয়েছিলেন প্রভাদেবী? হয়তো বা! বসু পরিবারে গান-বাজনার আসর বসত প্রায়ই। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের নদীতে মিশত রবীন্দ্রসঙ্গীত। আর এমন পরিবেশেই বেড়ে উঠেছিলেন উমা। পেয়েছিলেন গানের নির্জন দ্বীপের খোঁজ… 

কতই বা বয়স তখন। গীতিকার-সুরকার হরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শুরু হল সঙ্গীতশিক্ষা। কয়েকদিনেই মুগ্ধ হয়ে গেলেন শিক্ষক। এ তো ঈশ্বরপ্রদত্ত গলা! ঠিক যেন বাঁশির মতো। আর এই বাঁশির সঙ্গেই সাক্ষাৎ হল আরেকজন কিংবদন্তির। তিনি উমার বাবা ধরণীর বন্ধু— দিলীপকুমার রায়। কেবল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র হিসেবেই পরিচিত ছিলেন না; সঙ্গীতের জগতেও তিনি ছিলেন এক দিকপাল। ছোট্ট উমার গান শুনে সেই দিলীপকুমার রায়ও মুগ্ধ! এ তো বিরল প্রতিভা! স্বয়ং সরস্বতী বাস করছেন এই মেয়েটির গলায়। এঁকে আমিই শেখাব। কালে কালে গোটা ভারতে নাম ছড়িয়ে পড়বে হাসির… 

সেই থেকে শুরু হল এক অনন্ত সাধনার। স্রেফ উমাকে গান শেখাবেন বলে পণ্ডিচেরি থেকে কলকাতা চলে এলেন দিলীপ রায়। এমন প্রতিভার জন্য যত্ন প্রয়োজন, সঠিক রাস্তায় চলা প্রয়োজন। দিলীপ রায়ের সঙ্গে হাজির হলেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়। আর এই পুরো পরিবেশে যেন ডানা মেললেন উমা বসু। হয়ে উঠলেন সুরের ফিনিক্স পাখি। এমন সুন্দর, মিষ্টি গলা, সেইসঙ্গে সুর-তাল-লয়ের এমন অসামান্য মেলবন্ধন! ১৯৩২ সালেই বের হল প্রথম রেকর্ড। উমার বয়স তখন কত জানেন? মাত্র এগারো! 

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রায় সমস্ত বিভাগেই সাবলীল যাতায়াত ছিল উমার। সেইসঙ্গে ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত। আর ছিল গুরুদেব দিলীপকুমার রায়ের গান। দুজনের জন্মদিনও যে একই! রেকর্ড বের হওয়ার পর আর ধরে রাখা যায়নি উমাকে। গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর গান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ, শ্রী অরবিন্দ— উমার গানের ভক্ত অনেকেই। তখন তিনি বাংলাতেই আবদ্ধ নেই; ছড়িয়ে পড়েছেন গোটা ভারতে। ‘আজ ফাগুনের প্রথম দিনে’, ‘চাঁদ কহে চামেলি গো’, ‘আকাশের চাঁদ মাটির ফুলেতে’-র মতো বাংলা গানই হোল বা ঠুমরী, গজল, টপ্পা— উমা বসু যেন অনন্য… 

আরও পড়ুন
মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেন শ্যামল মিত্র, ভক্তদের জন্য গাইলেন বিশেষ গান

আর এই ছোট্ট বাঙালি মেয়েটির আওয়াজই পৌঁছে গেল মহাত্মা গান্ধীর কাছে। ১৯৩৭ সাল। শৈশব থেকে কৈশোরে পা দিয়েছেন উমা। তখনই তাঁর গান শুনলেন জাতির জনক। এবং মুগ্ধও হলেন। এ কি অদ্ভুত প্রতিভা! ঠিক যেন সুরেলা আওয়াজে বুলবুল গান গাইছে। মহাত্মা গান্ধী নাম দিলেন ‘নাইটিঙ্গেল অফ বেঙ্গল’। বাংলার বুলবুল! আরও বেশ কয়েক বছর পর মহারাষ্ট্রের এক গায়িকাও ‘ভারতের নাইটিঙ্গেল’ হবেন। তাঁরও আগে এই বাংলাই দেখেছিল বুলবুলকে… 

কিন্তু ভাগ্য! সমস্ত চেষ্টা, পরিশ্রম, প্রতিভা শেষ হয়ে যায় এই একটি জিনিসে টাল খেলে। উমা বসুর জীবনও বিশ্বাসঘাতকতা করল তাঁর সঙ্গে। যে সময়টা তাঁর বেড়ে ওঠার সময়, হেসেখেলে, গান গেয়ে উদযাপনের সময়; তখনই তাঁর শরীরে বাসা বাঁধল ভয়াল রোগ। যক্ষ্মা! তখনকার দিনে যক্ষ্মা যে কী সাংঘাতিক ছিল তা আর বলতে হবে না। মোড়ে মোড়ে শোনা যেত ‘দাদা, আমি তো বাঁচতে চেয়েছিলাম!’ উমাও হয়তো তাই বলতেন। তিনি তো বাঁচতে চেয়েছিলেন, গান গেয়ে শান্তি পেতে চেয়েছিলেন! আর তাঁরই গলায় কিনা বাসা বাঁধল এই রোগ! সুরের বদলে দমকা কাশি, আর চাপ চাপ রক্ত। শরীর যেন কুঁকড়ে যাচ্ছে। মাত্র ২১ বছর বয়স তাঁর। ১৯৪২ সালে নিজের জন্মদিনের দিন পরিস্থিতি যেন আরও খারাপ হল। শেষে নিজের জন্মদিনের দিনই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন উমা ‘হাসি’ বসু। থেমে গেল সব সুর… 

হিসেব করে দেখলে, এই বছর তাঁর জন্মের শতবর্ষ পূর্ণ হচ্ছে। অথচ চারিদিক কত শান্ত! ইতিহাসের পাতায় নির্জনতম স্থানেই বসে আছেন তিনি। তাঁর গান আজ আর কেউ শোনে কিনা জানা নেই। অথচ একসময় গোটা ভারত অবাক হয়ে গিয়েছিল ছোট্ট এক বাঙালি মেয়ের প্রতিভায়। বাংলার বুলবুল কি থেমে যেতে পারেন? তিনি যে মরণেরও ঊর্ধ্বে… 

আরও পড়ুন
‘আমার সোনার বাংলা’র পাশ্চাত্য সঙ্গীতায়োজন, কলকাতা-ঢাকা-লন্ডন এক সূত্রে বেঁধেছিলেন সমর দাস

তথ্যসূত্র-
১) ‘Remembering Uma Bose, who presaged a new era for vocal music’, Amit Chaudhuri, Scroll
২) ‘বাংলার বুলবুল উমা বসু: জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি’ রাজেশ দত্ত, কুলায় ফেরা 

Powered by Froala Editor

More From Author See More