মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে সমকামীদের পাশে আফগান-আমেরিকান ঔপন্যাসিক

২০১৯ সালের শেষ দিক। তখনও বিশ্বজুড়ে থাবা বসায়নি করোনাভাইরাস। এমনই এক সন্ধ্যায় কলকাতার আমেরিকান সেন্টারে এক ভিন্ন লড়াইয়ের গল্প শুনিয়েছিলেন দীর্ঘদেহী আফগান ভদ্রলোকটি। অনুষ্ঠানটির সাক্ষী ছিল প্রহরও। সেই দীর্ঘ আফগান পুরুষ আর কেউ নন, ঔপন্যাসিক নেমাত সাদাত। আরও ভালো করে বলতে গেলে, আফগানিস্তানের প্রথম সমকামী ঔপন্যাসিক তিনি। বর্তমানে আমেরিকার নাগরিক হলেও, আফগানিস্তানেই তাঁর বেড়ে ওঠা।

২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর লেখা প্রথম গ্রন্থ ‘দ্য কার্পেট উইভার’। উল্লেখ্য, আফগান উপন্যাসটি আবর্তিত হয়েছে একটি সমপ্রেমের কাহিনিকে ঘিরেই। সে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রের রয়েছেন দুই সমকামী পুরুষ কার্পেট শিল্পী। পটভূমি, আফগানিস্তান। যেখানে একুশ শতকে দাঁড়িয়েও সমকামীতা মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ। যুদ্ধ, সমাজ আর ধর্মের বেড়াজাল যে তাঁদের সম্পূর্ণ পরাধীন করে রেখেছে নিজের মাতৃভূমিতেও, সে-কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে ‘দ্য কার্পেট উইভার’-এর ছত্রে ছত্রে। আফগানিস্তানের সেই বাস্তব পরিস্থিতি এবং ভয়বহতাকেই নিপুণভাবে নিজ-উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছিলেন নেমাত সাদাত। আর তা হবে নাই বা কেন? তিনি নিজেও তো শিকার এই মধ্যযুগীয় গোঁড়া মানসিকতার। 

বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর। আফগানিস্তানে বেজে উঠেছিল যুদ্ধের দামামা। আশির দশকের শুরুর দিক সেটা। একটু একটু করে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করছে তালিবান। প্রাণ বাঁচাতে সন্তানদের নিয়ে বাধ্য হয়েই দেশ ছেড়েছিলেন তাঁর মা। বাবা তখনও আফগান রাষ্ট্রদূত হিসাবে কর্মরত জার্মানিতে। পরবর্তীতে তিনিও চলে আসেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। সাদাতের বেড়ে ওঠা সেখানেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বুকে উদারপন্থী, প্রগতিশীল সমাজ পেলেও পিছু ছাড়েনি বৈষম্যের ছায়া। প্রথমত তিনি যে আফগান শরণার্থী, তার ওপরে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ। ফলে, খানিকটা সন্দেহের চোখেই তাঁকে দেখছেন স্থানীয় মার্কিনিরা। ৯/১১-র বিস্ফোরণের পর আরও কঠিন হয়ে উঠেছিল পরিস্থিতি। 

তবে শুধুই কি জাতিগত প্রতিবন্ধকতা? বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাঁর লিঙ্গপরিচয়ও। ২০১২ সাল। শিকড়ের টানেই আমেরিকা থেকে আফগানিস্তানে ফিরেছিলেন সাদাত। অধ্যাপক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন কাবুলের আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অফ আফগানিস্তানে। সমকামিতা সম্পর্কে আফগানিস্তানের মনোভাব, মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা এবং সামাজিক লিঙ্গ রাজনীতির ছবিটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর কাছে। না, এর পরে আর চুপ করে বসে থাকতে পারেননি সাদাত। সোশ্যাল মিডিয়াকে হাতিয়ার করে আফগানিস্তানে এলজিবিটি আন্দোলনের অন্যতম শরিক হয়ে ওঠেন তিনি। শুধু প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষদের অধিকারের জন্যই নয়, বরং সামগ্রিকভাবে আফগান সমাজকে মুক্তমনা ও সচেতন করার লড়াইতে নেমেছিলেন সাদাত।

আরও পড়ুন
‘হ্যাঁ, আমি সমকামী’, অলিম্পিকে সোনা জিতে গর্বিত উচ্চারণ টমের

তবে খুব বেশিদিন আত্মগোপন করে চালিয়ে যাওয়া যায়নি এই কাজ। মাত্র এক বছরের মধ্যে পাল্টে যায় গোটা পরিস্থিতি। বিষয়টি আফগান সরকারের নজরে আসতেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত করা হয় তাঁকে। অন্যদিকে একাধিক ইসলামিক সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর থেকে ধেয়ে আসছে একের পর এক ফোন। প্রাণনাশের হুমকি। পরিস্থিতি বাধ্য হয়েই দেশ ছাড়েন সাদাত। তবে পারিপার্শ্বিক চাপ তাঁর লড়াকু মানসিকতাকে দমাতে পারেননি। ২০১৩ সালে নিজেকে সমকামী হিসাবে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন সাদাত। কিন্তু মার্কিন সমাজ তাঁকে সাদরে গ্রহণ করলেও, মেনে নেয়নি তাঁর নিজের পরিবার। 

সাদাতের পর, গতানুগতিক সামাজিক কাঠামো ভেঙে আত্মপ্রকাশ করেছেন একাধিক আফগান তরুণ-তরুণী। আর তার পিছনে যে অন্যতম অবদান রয়েছে সাদাত নেমাতের, তা অস্বীকার করার জায়গা নেই কোনো। নিজের মাতৃভূমির থেকে দূরে বসেও যেন লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন সাদাত। ব্যক্তিগত লেখা, সাংবাদিকতাকে হাতিয়ার করে খুলে দিতে চাইছেন সমানাধিকারের দরজা। 

আরও পড়ুন
জাতীয় পুরস্কার পেলেন দেশের প্রথম স্বঘোষিত সমকামী অভিনেতা বেঞ্জামিন

বর্তমানে দু’দশক পর ফের আফগানিস্তান তালিবানের দখলে। ফেডারাল সরকার থাকার সময়ও সমকামীদের কোনো স্বাধীনতা ছিল না যে দেশে, তাঁদের বর্তমান পরিস্থিতি যে কতটা জটিল হয়ে উঠেছে তা নিয়েও সম্প্রতি সরব হয়েছেন নেমাত সাদাত। আমেরিকা, ব্রিটেনের মতো প্রথম সারির দেশগুলির কাছে তাঁর আর্জি, যে জরুরি ভিত্তিতে সাহায্যের হাত বাড়িতে দেওয়া হয় আফগান কুইয়ার সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছে। তাঁর ভাষায় নাজি আর তালিবানদের মধ্যে বাস্তবে তফাৎ নেই কোনোই। আগামীতে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি কী হতে চলেছে, তা জানা নেই কারোরই। কিন্তু প্রাণভয় উপেক্ষা করে সাদাতের এই লড়াকু মানসিকতা স্বপ্ন দেখাচ্ছে হাজার হাজার প্রান্তিক আফগানকে। সুদিনের পথ খুব একটা সহজ নয়। তবে সেই দুর্গমকে জয় করারই পথের হদিশ দিচ্ছেন ৪১ বছর বয়সী আফগান ঔপন্যাসিক…

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
সাতরঙা কার্পেট নিয়ে, কলকাতায় হাজির আফগানি সমকামী লেখক

More From Author See More