সাতরঙা কার্পেট নিয়ে, কলকাতায় হাজির আফগানি সমকামী লেখক

"তখন জর্জ বুশের পর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেন বারাক ওবামা। গোটা বিশ্ব দেখল এক ব্ল্যাক ব্যক্তিকে আমেরিকার মসনদে বসতে। ভেঙে গেল বহু বছরের এক ‘ইউজলেস ট্র্যাডিশন’। আর সেটাই ছিল আমার অনুপ্রেরণা। একজন কালো চামড়ার মানুষ যদি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারেন, তাহলে আমি কেন এমন একটি বিষয় নিয়ে উপন্যাস লিখতে পারব না?"

বলছিলেন নেমাত। নেমাত সাদাত। জন্মসূত্রে আফগান হলেও বর্তমানে তিনি একজন আমেরিকার নাগরিক। তিনি আফগানিস্তানের প্রথম সমকামী ঔপন্যাসিক। কিছুদিন আগেই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দি কার্পেট উইভার’। এই উপন্যাস প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এমন একটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করলেন নেমাত, তার কারণ উপন্যাসটি লেখা হয়েছে সমপ্রেমের কাহিনি নিয়ে। সমপ্রেমের আখ্যান রয়েছে অনেক, তবু উনি ব্যাতিক্রমী কেন? কারণ এই বইয়ের পটভূমি, নেমাতের জন্মস্থান আফগানিস্তান। যেখানে সমকামিতার অর্থ ছিল মৃত্যুদণ্ড। সেই প্রেক্ষাপটে দুই কিশোরের প্রেম, দুঃখ, বিচ্ছেদ এসবকে জড়িয়েই লিখিত এই উপন্যাস, যা আর পাঁচটি সাধারণ উপন্যাসের মতো নয়।

এই উপন্যাসকে নিয়েই কথা বলতেই নেমাত চলে এসেছেন কলকাতায়। গতকাল সন্ধেয় কলকাতার আমেরিকান সেন্টার ও প্রান্তকথার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছিল একটি আলোচনাসভা। সেই আলোচনাসভায় তাঁকে সঙ্গত করছিলেন 'প্রান্তকথা'র পক্ষ থেকে বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায় এবং 'প্রহর'-এর পক্ষ থেকে অনিতেশ চক্রবর্তী। বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়ের স্বাগতভাষণ এবং প্রথম প্রশ্নই যেন বেঁধে দিয়েছিল অনুষ্ঠানের মূল সুরটি। সেই সূত্র ধরেই, উপন্যাসের ভিতরের কথা থেকে উঠে আসছিল নেমাতের লড়াই, তাঁর জীবন। নেমাত ঘোষিতভাবে সমকামী এবং এলজিবিটিকিউ অ্যাক্টিভিস্ট। তিনি বলেন, উপন্যাসের মূল চরিত্র কনিষ্ক আসলে তিনিই। কথায় কথায় উঠে আসছিল ধর্মের প্রসঙ্গ, যুদ্ধের কথা। উপন্যাস শুরুই হচ্ছে এভাবে - ‘’Allah never forgives sodomy’’। এরপর এক ব্যক্তি চুমুক দিচ্ছেন পানপাত্রে। মদ্যপান ক্ষমার যোগ্য হলেও সমকামিতা এখনও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ ধর্মের কাছে। নেমাত জানান "লড়াই আসলে ধর্মের ভিতর থেকেই। আল্লাহই যদি তাঁকে বানিয়ে থাকেন তাহলে তাঁর এই যৌন চাহিদার দায়িত্ব কার? আমি যদি প্রাকৃতিক হই তাহলে আমার ইচ্ছাও প্রাকৃতিক।" প্রশ্ন উঠছিল ধর্মের ভিতর থেকেই।

দর্শকদের মধ্যে একজন প্রশ্ন করলেন কেবল ইসলামে কেন? সবধর্মের ভিতরই সমকামিতাকে অপ্রাকৃতিক বলে দেগে দেওয়ার একটা প্রবণতা আছে। হিন্দু পুরাণে আমরা মোহিনীর কথা পাই, অর্ধনারীশ্বরের কথা পাই। পাই শিখণ্ডীর কথাও। কিন্তু সেসবই প্রতীকের আড়ালে। তাই সব ধর্মের ভিতরেই এই সমকামিতাকে প্রান্তিক করে রাখার একতা প্রবণতা রয়েছে। তাহলে মানুষের পরিচিতি কি দিয়ে ডিফাইন হবে? তার ধর্ম, তার দেশ নাকি তার যৌনসত্তা?’

নেমাত উত্তর দেওয়ার চেষ্টার সঙ্গেই পাল্টাচ্ছিলেন তাঁর উপন্যাসের পাতা। সেখানে এই প্রশ্নগুলিই সামনে এসেছে। জন্মসূত্রে মুসলমান একজন ছেলে জানতে পারে তার সম্প্রদায়ে তার প্রেম নিষিদ্ধ। প্রেমের জন্য সে দেশ ছাড়ে। চলে আসে পাকিস্তান। তারপর বহু ঘটনাচক্রের শেষে চলে যায় আমেরিকায়। সেই আমেরিকায়, যার কারণে আফগানিস্তানের এক বিরাট অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে।

এই আলোচনাচক্রের মিডিয়া পার্টনার ছিল প্রহর.ইন। প্রেক্ষাগৃহ থেকে উঠে আসছিল প্রশ্নের পর প্রশ্ন, মানুষ জানাচ্ছিলেন তাঁদের নিজেদের অভিজ্ঞতাও।

আর কী বললেন নেমাত? তাঁর লেখক জীবনের কথা না ব্যক্তি জীবনের কথা? নাকি এসবের উর্দ্ধে শাশ্বত এক মানবসত্তা উঠে এল তাঁর বক্তব্য থেকে?

এলজিবিটিকিউ মুভমেন্টের মুখ নেমাত জানান যে, ধর্ম ত্যাগ করে অনেকেই সমকামী হিসেবে নিজেদের আত্মপ্রকাশ করেছেন। আবার অনেকেই ধর্মকে ত্যাগ করতে পারেননি। ধর্মকে সরিয়ে রেখে যারা এগিয়ে এসেছেন, আত্মপরিচয় দিয়েছেন, তাঁদের লড়াই আরও কঠিন।

দিলখোলা মানুষটি হাসতে হাসতে তাই সহজেই বলে দিতে পারেন, “আমার তো প্রত্যেকটা পুরুষকে দেখে মনে হয় তারা গে। বরং তারা এসে আমাকে প্রমাণ করুক যে তারা গে নয়, তারা স্ট্রেট।” তাঁর এই মজার মধ্যেও লুকিয়ে রয়েছে অদ্ভুত এক আত্মবিশ্বাস। নিজের মতো করে চারপাশের জগতকে দেখার এই ক্ষমতা, গতানুগতিকের বাইরে গিয়ে, অবাক করে। এই উপমহাদেশে কি আদৌ কোনো সমকামী ভাবতে পেরেছেন এভাবে? না নেমাতের ‘হয়ে ওঠা’ই তাঁকে এমন স্বাধীনচেতা করে তুলেছে?

এই উপন্যাসটি উৎসর্গ করা হয়েছে এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের মানুষদের উদ্দেশ্যে। প্রহরের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয় - অনেকেই দাবি করছেন এই উপন্যাস এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের একটি দলিল, কিন্তু এটা কি একটি উপন্যাসের পরিচয় হতে পারে? উত্তরে মুচকি হাসেন নেমাত, তিনি জানান উপন্যাসটি সর্বজনীন। এটি একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের হলে আবারও প্রমাণ হবে যে তাঁরা সমাজের এক প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছে। কারণ কোনো উপন্যাসই কারোর একার জন্য হয় না। তাঁর কলম সেই সাম্যেরই স্বপ্ন দেখে। ব্যক্তিগত যৌনপরিচয়ের সম্মান নিয়ে যেন বাঁচেন প্রত্যেক মানুষ। কেননা, প্রেমের কোনো বিভাজন হয় না। ভালোবাসারও নয়।

প্রশ্ন ওঠে আফগান সাহিত্য নিয়েও। খালেইদ হোসেনির পর আফগান সাহিত্যে তেমন কোনও নাম উঠে আসেনি কেন? নেমাত জানান, নব্বইয়ের দশকের আগে বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে সমানে টক্কর দিতে পারত আফগান সাহিত্য। কিন্তু তারপর খেই হারিয়ে গেছে সে-দেশের সাহিত্যের। বলতে বলতে কি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি?

ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আলোচনায় যোগদান করেছিলেন বাংলাদেশের এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হোচিমিন ইসলামও। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনই সম্ভবত তৈরি করেছিল সন্ধ্যার সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্ত। যখন অনুষ্ঠানে উপস্থিত আমেরিকান সেন্টারের ডিরেক্টর মনিকা শাই তুলে আনেন জুলহাজ মান্নানের কথা, আর সমস্ত শ্রোতা নিশ্চুপ হয়ে যায় বিষাদে। জুলহাজ ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম এলজিবিটি ম্যাগাজিন ‘রূপবান’-এর প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। ২০১৬ সালে খুন হন তিনি। কিন্তু এই লড়াই তো ফুরোবার নয়! নেমাত হোচিমিন-কে আশ্বাস দেন, দক্ষিণ এশিয়ার এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষের লড়াইয়ের শরিক হবেন তিনিও। সাউথ এশিয়ান ইয়ং কুইর অ্যাক্টিভিস্টস নেটওয়ার্ক বা 'SAYAN'-এর সদস্যরাও অনুপ্রাণিত হবেন নেমাতের মতো মানুষকে কাছে পেলে। SAYAN-এর বয়স খুব বেশি না হলেও, ইতিমধ্যেই এলজিবিটি সম্প্রদায়ের অধিকারের লড়াই নিয়ে পথ হেঁটেছে অনেকটাই।

নেমাত-কে আরও কিছুদিন কাছে পাবে কলকাতা। তারপর, হয়তো ফিরে যাবেন আমেরিকায়। বা অন্য কোনো দেশে পাড়ি জমাবেন। কথা বলবেন তাঁর বই নিয়ে। দর্শন ও লড়াই নিয়ে। দেশে-দেশে ছড়িয়ে দেবেন এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকারের দাবি। নিজেকে তুলে ধরবেন ‘আত্মবিশ্বাস’ হিসেবে। পরের বইতেও থাকবে সেই প্রতিধ্বনিই। তিনি পারেন। পারবেন। তিনি নিজেই তার প্রমাণ। কলকাতা সাক্ষী রইল তার...