স্যাটালাইট প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করেই কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব আনছেন নাসার বিজ্ঞানী ক্যাথরিন

চারিদিকে ভরা ক্ষেত। চাষিদের নিত্যদিনের সঙ্গী এই বিস্তীর্ণ জমি। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি বছরের প্রতিটা দিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে একটু একটু করে ফসল ফলান তাঁরা। কিন্তু সময় কি আর এক থাকে? কখনও ফলন ভালো হয়, কখনও খারাপ। বন্যা, খরা হলে তো কথাই নেই। কেমন হয়, যদি আগে থাকতেই সমস্ত খবর কৃষকদের হাতের নাগালে চলে আসে? যেখানে ফসল ফলাচ্ছেন, সেই জায়গার জমি, পরিবেশ, জলবায়ু সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পান? এবং এতে ফলনও বৃদ্ধি পায়? 

বেশ কিছু বছর ধরে এই কাজটিই করে যাচ্ছেন নাসার বিজ্ঞানী ডঃ ক্যাথারিন নাকালেম্বে। উগান্ডা এবং আফ্রিকার বিস্তীর্ণ জায়গায় কৃষকদের কাছে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন প্রযুক্তি। নাসায় কাজ করার দরুন, স্যাটেলাইট টেকনোলজি নিয়ে তো রীতিমতো পড়াশোনা করেছেন তিনি। সেই জিনিসকেই কাজে লাগাচ্ছেন চাষের কাজে। কৃষকদের কাছেও সহজভাবে পৌঁছে দিচ্ছেন সেইসব তথ্য। আর সমস্ত কিছু মিলিয়ে আফ্রিকার কৃষিক্ষেত্রে ছোটোখাটো বিপ্লব আনারই চেষ্টায় ক্যাথারিন।     

অবশ্য যাত্রাটি এরকম ছিল না। উগান্ডায় জন্ম নেওয়া ডঃ ক্যাথারিন নাকালেম্বে ছোটোবেলায় চুটিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলতেন। ইচ্ছে ছিল স্পোর্টস সায়েন্স বা ক্রীড়াবিজ্ঞান নিয়ে উচ্চশিক্ষা করবেন। কিন্তু স্কলারশিপ না পাওয়ায় আর সেই বিষয় নিয়ে পড়া হল না। তার বদলে জীবনে এল পরিবেশ বিজ্ঞান। যত সময় এগোয়, এই বিষয় আরও আঁকড়ে বসে তাঁকে। গবেষণার জন্য উগান্ডা ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন আমেরিকায়। পরবর্তীকালে সেই দেশই তাঁর জীবনে অন্য এক মোড় নিয়ে আসে। 

নাসার বিজ্ঞানী হওয়া তো বটেই, আমেরিকার মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূবিজ্ঞানের অধ্যাপকের আসনটিও অর্জন করলেন ক্যাথারিন। কিন্তু মনের ভেতর উগান্ডা এবং আফ্রিকা থেকে গিয়েছিল। ভাবছিলেন সেখানকার কৃষকদের কথা। আমেরিকার কৃষিব্যবস্থার মতো এত আধুনিক, প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত এবং কর্পোরেট মানচিত্র তো নেই ওই দেশে। আফ্রিকার ওই পরিবেশে চাষ করাই অন্যরকম এক চ্যালেঞ্জ। আর সেই সুবিধা-অসুবিধা নিয়েই কাজ করেন কৃষকরা। সবসময় খরা-বন্যার আগাম আভাসও পাওয়া যায় না। ফসলও নষ্ট হয় বিপুল পরিমাণে। তাহলে উপায়? 

আরও পড়ুন
ধানের জমিতেই শুরু হতে চলেছে মাছচাষ, কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব পুরুলিয়ায়

ডঃ ক্যাথারিন নাকালেম্বে ঠিক করলেন, স্যাটেলাইট প্রযুক্তির সাহায্যে কৃষকদের যদি সাহায্য করা যায়। কিন্তু মহাকাশ থেকে কোনটা ধান, কোনটাই বা গম, ভুট্টা— সেটা কেমন করে বোঝা যাবে? ঠিক করলেন, কেবল স্যাটেলাইট দিয়ে কাজ হবে না। কৃষকদের থেকেও তথ্য নিতে হবে। এক-দুবছরের নয়; অন্তত ২০-৩০ বছরের। তা নাহলে জমির চরিত্র, কী ফসল ফলানো হয়, কীরকম বণ্টন সেসব বোঝা যাবে কী করে! আর তার জন্য নিজেই পৌঁছে গিয়েছিলেন আফ্রিকা ও উগান্ডার চাষিদের কাছে।    

আরও পড়ুন
বৃষ্টিতে মাঠ ভরেছে সবুজে, কৃষিকাজে ফিরে স্বস্তি পরিযায়ী শ্রমিকদের

এবং এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই একটি কৃষিজ মানচিত্র তৈরি করেন ক্যাথারিন। এবং সেই সবকিছুকে এক করে একটি আধুনিক অ্যাপও নিয়ে আসেন। যেখানে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আবহাওয়ার সমস্ত তথ্য আগাম পৌঁছে যাবে কৃষকদের কাছে। জলবায়ুর ওপরও তো জমির চরিত্র, ফসলের ফলন নির্ভর করে। সেখানে সামান্য এদিক-ওদিক হলেও চাষের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। সেই ব্যাপারটিই আগে থেকে বলে দেবে স্যাটেলাইট। শুধু তাই নয়, এর মাধ্যমে সমস্ত মিডিয়া, রেডিও’র সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারবে কৃষকরা। 

আরও পড়ুন
শ্রমিক দিবসের বহু আগেই, ১ মে কৃষি উৎসব পালিত হত প্রাচীন ইউরোপে

ডঃ ক্যাথারিন নাকালেম্বে’র একটাই উদ্দেশ্য, এই মানুষগুলো যাতে না খেতে পেয়ে মারা না যায়। যদি আগেভাগে সমস্ত খবর পাওয়া যায়, এবং সমস্তরকম আপৎকালীন ব্যবস্থা নেওয়া হয়; তাহলে ফসল নষ্ট হবে না। আর সেটা হলে তো ভালোই! আর এই কাজের জন্য ২০২০-র আফ্রিকা ফুড প্রাইজও পেয়েছেন ডঃ ক্যাথারিন নাকালেম্বে। সবাই মিলে হাত ধরে চললে নিজেদের পরিবেশকেও বাঁচাতে পারব আমরা, সেটাই উঠে আসে এই বিজ্ঞানীর কাজ থেকে।

Powered by Froala Editor