২০০ বছর আগের যে নীতি ভেঙে দিয়েছিল ভারতীয় কৃষি-সভ্যতার ভিত

২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০। ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলি নানা বিষয় নিয়ে ইতিমধ্যেই নিজেদের ‘ব্যস্ত’ রেখেছে। তার মধ্যেই ভেসে আসছিল একটি বিশেষ খবর। গত শুক্রবার গোটা দেশের রাস্তা তারই প্রতিচ্ছবি দেখল। হ্যাঁ, কথা হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক কৃষি বিল নিয়ে। ইতিমধ্যেই যথেষ্ট বিতর্ক তৈরি করেছে এটি। পাঞ্জাব-হরিয়ানার কৃষকরা রাস্তায় নেমে এসেছেন অনেক আগেই। এবার গোটা দেশে সেই ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল। সরকারও নিজেদের দিকটা বোঝানোর কাজ করছে। কিন্তু কৃষির ওপর এমন কর্পোরেট-রাজ আখেরে গোটা কৃষক সমাজকে আরও অন্ধকারে ঠেলে দেবে, তারই কথা বলছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। 

বর্তমান থেকে একটু অতীতের দিকেও নজর ফেরানো যাক। কথায় বলে, ইতিহাস নাকি নিজের নিয়মেই ফিরে আসে। ১৭৯৩ সাল। ততদিনে পলাশির প্রান্তরে পরাজিত হয়েছেন বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা। যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই দেশে এসেছিল স্রেফ বাণিজ্য করার জন্য, রাতারাতি তাঁরাই হয়ে গেল শাসক। ভারতের আইনকানুন, নিয়মশৃঙ্খলা নির্ধারণ করতে লাগলেন ব্রিটিশ সাহেবরা। আর দেশের মাটিতেই পরাজিত প্রজার দিন কাটাতে লাগলেন ভারতবাসী। ক্লাইভের পর লর্ড চার্লস কর্ণওয়ালিশ ভারতে আসেন গভর্নর জেনারেল হয়ে। আর তারপরই শুরু করেন ইতিহাসখ্যাত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ নীতি। দেশের কৃষি ব্যবস্থার ছবিটাই বদলে যায় যে সময়ের পর…

ঠিক কী বলা উচিত এই নীতিকে? বিখ্যাত, না কুখ্যাত? একেকজন ঐতিহাসিক এক এক ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন একে। বাকি বিচারের ভার না হয় আপনারাই নিলেন। কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুপ্রভাবের দিকেই চোখ যায় আমাদের। ১৭৮৬ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল হয়ে আসার পর কর্নওয়ালিশ ভারতের ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা নিয়ে সমীক্ষা চালান। তারপর ১৭৯০ সালে এসে একটি নতুন ব্যবস্থা প্রণয়ন করেন; নাম ‘দশসালা বন্দোবস্ত’। ঠিক করেন, ইংল্যান্ড থেকে অনুমতি না এলে দশ বছর এই ব্যবস্থা চলবে। নানা বিরোধ দেখা দিলেও, শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ড সরকার কর্নওয়ালিশকে সমর্থন জানান। ফলস্বরূপ, তিন বছর পর ১৭৯৩ সাল থেকে এর নাম বদলে হয়ে যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।

এই নীতি অনুযায়ী, জমিদার এবং তালুকদাররা চিরস্থায়ীভাবে নিজেদের জমির ওপর মালিকানা লাভ করেন। প্রাথমিকভাবে কোম্পানি বলেছিল, এই বন্দোবস্তের ফলে দেশের কৃষি ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি ঘটবে। জমি নিজেদের হাতে পেয়ে দেশীয় জমিদাররা আরও বেশি মন দেবেন সেখানে। এর বাইরে আরও বেশ কিছু ভাবনাচিন্তা কর্নওয়ালিশ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাথায় ঘুরছিল। এভাবে জমিদারদের হাতে সবটা ছেড়ে দিলে তাঁরা ব্রিটিশদের আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত হবে। সাহেবদের অনুগতও হবেন; ফলে ইংরেজদেরও কাজ করতে ও শাসন ক্ষমতা বিস্তার করতে সুবিধা হবে। সেইসঙ্গে কোম্পানিকে একটি নির্দিষ্ট হারে রাজস্বও পাঠাবেন সেই জমিদাররা। ফলে একটা আয়ের পথও খোলা থাকবে। 

ঠিক যেমনটা ভাবা হয়েছিল, তেমনটাই ঘটল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত লাগু হবার পর দেশীয় জমিদার ও তালুকদারের দল ইংরেজদের অনুগত হয়ে গেল। তাঁদের হাতে রাখলে যে নিজেদেরও লাভ, এই কথা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন লর্ড কর্নওয়ালিশ। দেশের জমি বরং ওঁরাই দেখুক। ইংরেজরা রাজার জাত, সব ব্যাপারে মাঠে নামলে হয় নাকি! কৃষি ব্যবস্থারও উন্নতি ঘটে। সেইসঙ্গে কোম্পানির কোষাগারও ভরতে থাকে। একটি সফল ব্যবসায়িক চুক্তি হিসেবে চিহ্নিত করাই যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’কে। 

কিন্তু এর আড়ালেই লুকিয়ে থাকে আসল ছবিটা। যেখানে কেবলই রক্ত, কেবলই হাহাকার। কৃষকদের হতাশ মুখ। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আসার ফলে জমির ওপর থেকে কৃষকদের অধিকার চলে যায় বরাবরের মতো। তাঁরাই কষ্ট করে ফসল ফলাচ্ছেন, অথচ সেই জমির ওপর তাঁদেরই কোনো অধিকার নেই। সমস্ত মালিকানা জমিদার আর তালুকদারদের। নিজেদের হাত থেকে যাতে জমি না যায়, তার জন্য কৃষকদের ওপর চলে অত্যাচার। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অন্যতম দুটো শর্ত হল, নিজের জমি নিয়ে জমিদার যা খুশি করতে পারেন। কিন্তু রাজস্ব যেন ঠিকঠাক আদায় করা হয়। নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের আগে জমিদাররা গিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধিকে টাকা দিয়ে আসত। না দিলেই, জমি কেড়ে নেওয়া হবে। স্রেফ এই ভয়তেই কৃষকদের ওপর চলত জুলুম। 

রাজস্ব বাদ দিয়ে জমিদারের ঘরেও যাতে কিছু ঢোকে, তার জন্য বাড়তি রাজস্ব আদায় করা হত কৃষকদের থেকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার পরিমাণটা ছিল কয়েকগুণ। এছাড়াও, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও রাজস্বের পরিমাণ কমত না। ফলস্বরূপ, কৃষকদের ঘর জ্বলল। পরিবার নিয়ে প্রায় পথে নেমে এলেন তাঁরা। জমিদারের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অনেকে প্রাণও দিলেন। সেইসঙ্গে তৈরি হল আরও একটি বিশেষ শ্রেণী, যারা ‘মহাজন’ এবং মধ্যস্বত্বভোগী বলে পরিচিত হলেন। জমিদারের টাকা শোধ করার জন্য মহাজনদের থেকে উচ্চ সুদে ধার নিতে বাধ্য হতেন কৃষক। ওদিকের টাকা তো শোধ হয়ে গেল, এবার এদিকে কী হবে? এই অদ্ভুত সাঁড়াশি চাপে পড়ে শেষ হতে লাগল একের পর এক গরিব চাষি। 

১৯৫০ সাল পর্যন্ত এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভারতে চালু ছিল। সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর এই প্রথা চিরকালের মতো বাতিল হয়ে যায়। সত্যিই কি তাই? যে ছবিটা উঠে এল, তার সঙ্গে আজকের দিনের মিল কি পাওয়া যাচ্ছে না? যদি ধীরে ধীরে কর্পোরেট ব্যবস্থার দিকে যেতে থাকে কৃষি, তাহলে আবারও অন্যরূপে এইদিন ফিরে আসবে না, সেটা কী করে বলা যায়! যেখানে সরকার নিজেরাই সরে যাবে! গরীব কৃষকরা কীভাবে ভরসার মুখ দেখবেন? প্রশ্ন অনেক। ইতিহাস শিক্ষা দিয়েছে আমাদের। আমরা শিক্ষা নিচ্ছি কি? 

তথ্যসূত্র-
১) ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কী? এর উদ্দেশ্য কী ছিল?’, ইতিহাস টুয়েলভ
২) ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা’, কালের কণ্ঠ 

Powered by Froala Editor

More From Author See More