মানুষের অভাব মেটায় পুতুল, কোথায় রয়েছে এই আশ্চর্য গ্রাম?

সবমিলিয়ে প্রায় ৬ হাজারেরও বেশি দ্বীপ নিয়ে গঠিত সূর্যোদয়ের দেশ জাপান। তবে প্রধানত চারটি বৃহত্তর দ্বীপ নিয়েই গঠিত জাপানের মূল ভূখণ্ড। তার মধ্যে সবচেয়ে ছোটো দ্বীপ শিকোকু। এই পার্বত্য দ্বীপেই রয়েছে আশ্চর্য এক গ্রাম। যেখানে জনসংখ্যা মাত্র ২৫ থেকে ৩০ জন। অথচ, স্কুল, হাসপাতাল, কমিউনিটি হল— গ্রামের সর্বত্রই গেলেই দেখা মূলবে অজস্র মানব প্রতিকৃতির। না, দেহের গড়ন মানুষের মতো হলেও, প্রাণ নেই তাদের। তারা সকলেই আদতে পুতুল।

নাগোরো (Nagoro)। জাপানের পুতুল-গ্রামটি (Village Of Dolls) পরিচিত এই নামেই। কিন্তু কীভাবে এই গ্রামে গড়ে উঠল পুতুলদের এই আশ্চর্য রাজত্ব? কেন এই গ্রামের প্রতিটি বাড়ি, স্কুল, হাসপাতালে গেলেই দেখা মেলে পুতুলদের? আর এইসব পুতুলদের মালিকানাই-বা কার?

না, কোনো ভৌতিক বা অলৌকিক ইতিহাস জড়িয়ে নেই এই গ্রামের সঙ্গে। আবার সেখানে যে প্রচুর কিশোর-কিশোরীর বাস— এমনটাও নয়। আসলে আজ থেকে দু-তিন দশক আগেও এই গ্রামের জনসংখ্যা ছিল ৩০০-র কাছাকাছি। তবে তারপর ক্রমাগত হ্রাস পেতে শুরু করে নাগোরোর জনসংখ্যা। আজ যা এসে ঠেকেছে মাত্র ২৬-এ। আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, এই গ্রামে শেষ কোনো শিশু জন্ম নিয়েছিল আজ থেকে ১৯ বছর আগে। ফলে, এই গ্রামের বর্তমান বাসিন্দাদের অধিকাংশই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এবং মধ্যবয়সী। জনসংখ্যার ঘাটতি কমাতে এবং নিঃসঙ্গতা দূর করতেই পুতুল দিয়ে শূন্যস্থান ভরানোর চেষ্টা করে চলেছেন নাগোরোর বাসিন্দারা। 

নাগোরোকে পুতুল দিয়ে সাজিয়ে তোলার নেপথ্যে রয়েছেন সুকিমি আইয়ানো নামের ৭০ বছর বয়সি এক জাপানি বৃদ্ধা। নাগোরোতেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা সুকিমির। তবে এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষের মতোই কর্মসূত্রে তিনি জন্মভূমি ছেড়ে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন রাজধানী টোকিও-তে। আজ থেকে দু’দশক আগের কথা। ২০০২ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর জন্মভূমিতে ফিরে আসেন সুকিমি। তবে মাতৃভূমিতে ফিরে আনন্দিত হওয়ার থেকেও বেশি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। কারণ, রাতারাতি যেন শূন্য হয়ে গেছে আস্ত গ্রামটা। ষাটের দশকেও যেখানে কয়েক হাজার মানুষ বাস করতেন নাগোরোতে, সেখানে সেই জনসংখ্যা ততদিনে এসে দাঁড়িয়েছে ১০০-র কাছাকাছি। 

এই নিঃসঙ্গতা কাটাতেই একক উদ্যোগে কাপড়ের পুতুল তৈরি শুরু করেন সুকিমি। তুলো, রোল কাগজ এবং কাঠের গুঁড়োর মতো উপাদান সংগ্রহ করতে থাকেন গ্রামের মানুষদের থেকেই। তারপর হাতে তৈরি পুতুলদের তিনি স্থাপন করেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে হাসপাতাল, কমিউনিটি সেন্টার ও অন্যান্য জায়গায়। যাঁরা পেশায় শিক্ষক ছিলেন, তাঁরা এখনও স্কুলে হাজির হয়ে ক্লাস নেন নির্বাক ছাত্রছাত্রীদের। প্রবীণ চিকিৎসক হাসপাতালে গিয়ে প্রতিদিন দেখে আসেন পুতুল-রোগীদের। এমনকি কখনও কখনও গ্রামের খামারে ও রাস্তার ধারেও কুকুর ও অন্যান্য প্রাণীর আদলে তৈরি পুতুল চোখে পড়বে নাগোরোতে। তারাও মানুষের কর্মসঙ্গী।

অবশ্য আজ সুকিমি একা নন মোটেই। তাঁর সঙ্গে পুতুল তৈরির এই কর্মকাণ্ডে যোগ দিয়েছেন গ্রামের অনেকেই। কেউ আবার বার্ধক্যের জন্য পুতুল তৈরিতে সক্ষম না-হলেও বাতিল জামাকাপড় ও অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে সাহায্য করেন পুতুল শিল্পীদের। 

বছর কয়েক আগে জাপানের এক চিত্রসাংবাদিকের সৌজন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে এই গ্রামের বেশ কিছু ছবি। তারপর থেকেই ক্রমশ বেড়ে চলেছে ‘পুতুলগ্রাম’ নাগোরোর জনপ্রিয়তা। বর্তমানে দেশ-বিদেশের পর্যটকরাও নিয়মিত ভিড় জমান এই পুতুল-রাজত্ব প্রত্যক্ষ করার জন্য। তা যেন গ্রামবাসীদের বাড়তি পাওনা। অচেনা পর্যটকদের সঙ্গে দু’দণ্ড গল্প করার ফুরসৎ পান গ্রামের প্রবীণ-প্রবীণারা। তাছাড়াও বহু পর্যটকও পুতুল বোনাও শেখেন এই গ্রামে এসে। প্রতিবছর এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতি বুধবার করে তাঁদের পুতুল তৈরির প্রশিক্ষণ দেন সুকিমি। সবমিলিয়ে এই গ্রামে পুতুলরাই হয়ে উঠেছে মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গী। 

Powered by Froala Editor