কোথায় সেই ‘লচ নেস মনস্টার’? ৩ দশক ধরে অনুসন্ধান স্টিভের

স্কটল্যান্ডের লচ নেস। পাহাড় আর ঘন জঙ্গলে ঘেরা প্রকাণ্ড এই হ্রদ যেন আক্ষরিক অর্থেই ভ্রমণপ্রিয় মানুষের কাছে এক স্বর্গরাজ্য। তবে এই হ্রদের জলের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এক আশ্চর্য প্রাণী। প্রাণী না বলে তাকে দৈত্য বলেই শ্রেয়। স্কটল্যান্ড (Scotland) তো বটেই, গোটা ইউরোপে এই প্রাণী পরিচিত ‘লচ নেস মনস্টার’ (Loch Ness Monster) নামে। ৫৬৫ সালে আদমনানের ‘লাইফ অফ সেন্ট কলোম্বা’ গ্রন্থে প্রথম এই আশ্চর্য প্রাণীর কথা উল্লেখিত হলেও, লচ নেসে তার প্রথম দেখা মিলেছিল ১৮০২ সালে। তারও বহু বছর পর ১৯৩৪ সালে প্রথম ক্যামেরায় ধরা পরে এই দৈত্য। পেশিবহুল দীর্ঘ গলা তার। সেইসঙ্গে তিমির মতো শরীর সেই প্রাণীর। কিন্তু সত্যিই কি বাস্তব অস্তিত্ব আছে ‘লচ নেস মনস্টার’-এর?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শব্দতরঙ্গ বা সোনারের মাধ্যমে গোটা হ্রদ পরীক্ষা করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। তবে তেমন কোনো প্রাণীর অস্তিত্বের সন্ধান পাননি তাঁরা। তবে তা সত্ত্বেও আজও ইতিউতি শোনা যায় লচ নেস দৈত্য দর্শনের কথা। আজও রীতিমতো ইউরোপজুড়ে জনপ্রিয় এই জলদৈত্যের কিংবদন্তি। অবশ্য গবেষকরা হাল ছাড়লেও এই রহস্য সমাধানের জন্য প্রায় তিন দশক ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম চালিয়ে যাচ্ছেন স্টিভ ফেলথাম। 

আজ থেকে প্রায় বত্রিশ বছর আগের কথা। লচ নেসে ঘুরতে এসে প্রথম এই দৈত্যের দেখা পেয়েছিলেন ফেলথাম। নৌকায় চেপে হ্রদ ভ্রমণের সময় তাঁর চোখে ধরা পড়ে এক আশ্চর্য দৃশ্য। দ্রুত বেগে জলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে টরপেডোর মতো একটি জিনিস। জিনিসটাকে প্রথমে কোনো যন্ত্র বলে মনে হলেও, ফেলথাম বুঝতে পারেন, আদতে প্রাণ আছে তার। সেটি আর কিছুই নয়, বরং স্কটিশ রেডিও-তে শোনা লচ নেস মনস্টার। 

১৯৯১ সাল। ফেলথাম প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলেন, এই রহস্যের সমাধান করেই ছাড়বেন তিনি। কাজেই নিজের কর্মক্ষেত্রে ইস্তফা দিয়ে, চাকরি ছেড়ে চলে আসেন লচ নেসে। এমনকি ডরসেটে নিজের বাড়িটিও বিক্রি করে দেন তিনি। শুরু হয় দৈত্যের অনুসন্ধান। তবে কাজটা যে এতটা কঠিন হবে, তা নিজেও বুঝতে পারেননি তিনি। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারেও সে-কথা শোনা যায় তাঁর মুখে। 

হ্যাঁ, হতাশা তো আছেই। আসলে তিন দশক তো আর কম সময় নয়। পাশাপাশি এই দৈত্য খুঁজে বার করার নেশায় এক-কথায় স্বর্বশান্ত হয়েছিলেন তিনি। এই দৈত্য খুঁজে বার করতে এত সময় লাগবে, তা কল্পনাও করতে পারেননি ফেলথাম। 

তাঁর কথায়, এই প্রকল্প শুরু করার ঠিক ১২ দিনের মাথাতেই তিনি প্রথম দর্শন পেয়েছিলেন লন নেস মনস্টারের। কিছু ছবিও তুলেছিলেন তিনি। তবে জলের ভিতর সাঁতরে চলা প্রাণীটির কোনো স্পষ্ট প্রতিকৃতি ধরা পড়েনি ক্যামেরায়। ফলে, তা লচ নেস মনস্টারের প্রমাণ হিসাবে তিনি পেশ করতে পারেননি কোথাও-ই। এর পর কেটে গেছে প্রায় ৩২ বছর। অথচ, দ্বিতীয়বারের জন্য তাঁর সামনে ধরা দেয়নি লচ নেসের আশ্চর্য দৈত্য। 

মজার বিষয় হল, ফেলথাম এই প্রাণীর দেখা না-পেলেও, ইতিমধ্যেই একাধিক ব্যক্তি দাবি করেছেন যে তাঁদের চোখে ধরা পড়েছে লচ নেস। এমনকি গত বছরই দু’জন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি লচ নেস দর্শনের প্রেক্ষিতে উঠে এসেছিলেন সংবাদপত্রে। ফেলথামের কথায়, এ যেন ভাগ্যেরই পরিহাস। উন্নত মানের ক্যামেরা ও অন্যান্য যন্ত্রসামগ্রী নিয়ে তিনি সারাদিনই ঘুরে বেড়ান এই লেকে— অথচ তাঁর কাছেই আজও অধরা থেকে গেছে এই দৈত্য। 

অবশ্য এই দৈত্যের উপস্থিতি নিয়ে আজও তাঁর বিশ্বাস অটুট। ফেলথাম মনে করেন, আজ না-হয় তো কাল শনাক্ত হবে লচ নেস মনস্টার। প্রকাশ্যে আসবে এই আশ্চর্য প্রাণীর ছবি ও অন্যান্য তথ্য। 

অবশ্য ফেলথাম নিজে সফল না-হলেও, তাঁর এই দীর্ঘমেয়াদি অনুসন্ধানের জেরে বর্তমানে রীতিমতো জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে লচ নেস হ্রদ। প্রতিবছর এই আশ্চর্য প্রাণীর সন্ধান করতে সেখানে হাজির হন হাজার হাজার মানুষ। পর্যটন শিল্পে তাঁর এই অবদানের জন্য ২০১৬ সালে স্কটল্যান্ডের হাইল্যান্ডস অ্যান্ড আইল্যান্ডস টুরিজম পুরস্কার পান তিনি। সেরা সাম্মানিক রাষ্ট্রদূত হিসাবেও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। তাছাড়া লচ নেস মনস্টারের ওপর দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন নজরদারি চালিয়ে যাওয়ার জন্য গিনেস বুকের পাতাতেও নাম তুলেছেন ফেলথাম। সবমিলিয়ে দেখতে গেলে, তাঁর এই প্রয়াস, নিষ্ঠা, অনুসন্ধান— বিফলে যায়নি মোটেই। এক কিংবদন্তির অনুসন্ধান করতে করতে, নিজেই যেন স্বয়ং কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন ‘মনস্টার হান্টার’ ফেলথাম…

Powered by Froala Editor