কবিতার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল সংকেত, অবশেষে উদ্ধার ফরেস্ট ফেনের গুপ্তধন

রহস্য কে না ভালবাসে। আর তা যদি গুপ্তধন কেন্দ্রিক হয়, তবে তো কথাই নেই। গল্প হোক বা উপন্যাস, পড়তে পড়তে গুপ্তধনের সাংকেতিক ছড়ার মানে উদ্ধার করার চেষ্টা করেনি, এমন মানুষ খুব কমই আছেন। তবে এবার রূপকথা কিংবা সিনেমার প্লট থেকে বাস্তবে নেমে এল গুপ্তধনের অভিযান। সমাধান সম্ভব হল ১০ বছরের লুকিয়ে রাখা রহস্যের। যার আর্থিক মূল্য অন্তত ১০ লক্ষ মার্কিন ডলার।

ফরেস্ট ফেন। আমেরিকায় অনেকের কাছেই খুব পরিচিত এই ব্যক্তির নাম। কারণ নিউ মেক্সিকো শহরে তাঁর এক চেটিয়া ব্যবসা প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহের। প্রথম জীবনে আমেরিকার সৈন্যদলে যুদ্ধবিমান চালক ছিলেন ফেন। অংশ নিয়েছিলেন ভিয়েতনাম যুদ্ধেও। অবসর নেওয়ার পর স্ত্রীয়ের সঙ্গে এই ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ছবি থেকে শুরু করে পুরাতাত্ত্বিক ভাস্কর্য, ঐতিহাসিক নথি, মূর্তি, জহরত সবকিছুই রয়েছে তাঁর গ্যালারিতে। পাশাপাশি রয়েছে তাঁর বিখ্যাত ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা। তবে এসবের পিছনে তাঁর আরো একটা পরিচয় আছে। তিনি একজন লেখকও। রহস্যে মোড়া তাঁর জীবনকাহিনী ‘দ্য থ্রিল অফ দ্য চেস’ রীতিমতো বিখ্যাত। এই গ্রন্থেই তিনি সংকেত লুকিয়ে রেখেছিলেন গুপ্তধনের। পরিচিত গল্পের মতোই ২৪ লাইনের একটি কবিতায় নিহিত ছিল সেই গুপ্তধনের ঠিকানা। বিখ্যাত সেই ‘ফেন’স ট্রেজার’ এক দশক পর উদ্ধার হল।

সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যমে ফেন জানান, এক ব্যক্তি কিছুদিন আগেই খুঁজে পেয়েছেন তাঁর এই লুকিয়ে রাখা সম্পদ। নিজের ওয়েবসাইটে তিনি জানান, ওই ব্যক্তি গুপ্তধন উদ্ধারের পর ছবি পাঠিয়েছেন তাঁকে। ফেনের চিনতে অসুবিধা হয়নি নিজেরই লুকিয়ে রাখা সিন্দুক আর ধন-সম্পদগুলি। তবে ওই ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ্যে আনেননি ফেন। রাজি নন লুকিয়ে রাখা সংকেতের অর্থ এই মুহূর্তে প্রকাশ করতেও। তবে গুপ্তধন উদ্ধারের পর, এই ধাঁধাঁর সমাধান যে খুব তাড়াতাড়িই সামনে আসবে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত তিনি।

১৯৮৮ সালে ফেন আক্রান্ত হয়েছিলেন ক্যানসারে। শারীরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে বার বার চেষ্টা করেছেন আত্মহত্যার। কিন্তু শেষ অবধি দূরারোগ্য ব্যাধিকে হার মানিয়েছিলেন তিনি। ২০১০ সালে পুরোপুরি সুস্থতা ফিরে পেয়ে উদ্যোগ নেন রহস্যের জাল বোনায়। রকি পর্বতের দুর্গম স্থানে লুকিয়ে রাখেন ১০ কেজির মণি-মাণিক্যে ভরা একটি ব্রোঞ্জের সিন্দুক। যাতে ছিল ২৬৫টি ঈগলের স্বর্ণমূর্তি, মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু প্রাচীন স্বর্ণমুদ্রা, অসংখ্য সোনার টুকরো, যার কয়েকটির আয়তন মুরগির ডিমের মতো। এছাড়াও ছিল হিরে, পান্না, চুনি, স্যাফায়ারের মতো মূল্যবান পাথর, চিনের পুরাতাত্ত্বিক স্বর্ণমূর্তি, এবং অসংখ্য গহনা। ন’টি সংকেতের মধ্যে তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন এই গুপ্তধনের ঠিকানা। একমাত্র তাঁর স্ত্রী ছাড়া যার সন্ধান জানা ছিল না কারোরই। উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে বইয়ের পাতা থেকে বার করে এনে অভিযানের অংশ করে তোলা।

তবে ফেনের এই গুপ্তধনকে স্রেফ ধাপ্পাবাজি হিসাবে আক্ষা দিয়েছেন এমন মানুষেরও অভাব নেই। আবার পাশাপাশিই এই রহস্যের উন্মাদনাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে অজস্র ফেসবুক গ্রুপ, ওয়েবসাইট, ব্লগ, ফোরাম। অনেকে এই গুপ্তধনের সন্ধানে চাকরি ছেড়েছেন। কেউ কেউ অভিযানের নেশায় হারিয়েছেন সর্বস্ব। রহস্য উদ্ধার করতে গিয়ে প্রাণও গেছে পাঁচ জনের। ২০১৬ সালে কলোরাডোর এক ব্যক্তির মৃত্যুর পর, ফেন ঘোষণা করেছিলেন তাঁর তৈরি করা সংকেতটি কাল্পনিক। এর কোনো বাস্তব হদিশ নেই। তাঁর তৈরি রহস্য অভিযান যে প্রাণ নেবে কারোর, এটা তাঁর ভাবনাতীত ছিল।

নিজের ওয়েবসাইটে গুপ্তধন উদ্ধারের ব্যাপারে জানানোর সঙ্গে তিনি আনন্দও প্রকাশ করেন। জানান, তিনি চেয়েছিলেন মৃত্যুর আগে এই রহস্যের সমাধান দেখে যেতে। এত বছর পর ৮৯ বছর বয়সী অশীতিপর ফেন, সেই স্বপ্নপূরণের জন্য যারপরনাই উচ্ছ্বসিত। তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছেন তাঁর এই রহস্যের অংশ হয়ে ওঠা প্রত্যেককে। একই সঙ্গে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন পাঁচজনের প্রাণহানির ব্যাপারেও। তবে তিনি আশাবাদী ক্রমবিবর্তিত যান্ত্রিকতার মধ্যেও ভবিষ্যতে বজায় থাকবে মানুষের অভিযানের নেশা।

Powered by Froala Editor

More From Author See More