ঢাকের বোল ফিকে, নেই বায়নাও; সপ্তমীতেও ঢাকিদের মুখ অন্ধকার

শুরু হয়ে গেছে বাঙালির বচ্ছরকার উৎসব। তবুও উৎসবের আমেজেই মিশে আছে বিষাদের সুর। সেই সুর সঙ্গে নিয়েই কাঠি পড়েছে ঢাকে। দেখতে দেখতেই সপ্তমী। তবে ঝিম ধরা এবছরের পুজোর মণ্ডপে কটা ঢাক বেজে উঠল, তা হিসেব কে রাখে?

একদিকে যেমন ভাইরাসের সংক্রমণ। অন্যদিকে অর্থনৈতিক দুরাবস্থা। কাজেই সব পুজো কমিটিই ছাঁটাই করেছে বাজেটের একটা বড়ো অংশ। সেখানে যেমন আপোস করা হয়েছে প্যান্ডেল, মূর্তি, আলোকসজ্জায়। তেমনই টান পড়েছে বাদ্যযন্ত্রের হিসেবের খাতাতেও। কোথাও কমানো হয়েছে ঢাকিদের সংখ্যা। আবার কোথাও রেকর্ডেই সেই প্রয়োজন মিটিয়েছেন পুজোর কর্মকর্তারা। আর অন্যদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে পুজোর এই ক’টা দিনের ওপরে সারাবছর নির্ভর করে থাকা মানুষগুলোর সংসারে।

প্রতিবছর মহালয়ার পর থেকেই আস্তে আস্তে রূপ বদলাতে থাকে শিয়ালদহ স্টেশনের। হাজার হাজার ঢাকের শব্দে মুখরিত হয়ে থাকে প্ল্যাটফর্ম চত্বর। প্রতিবছর অগ্রিম বুকিং না থাকলেও যাঁরা বায়না পাওয়ার আশায় চলে আসেন শহরে, তাঁরাও এ-বছর আসেননি অনেকেই। 

পুজোর মরশুমে কলকাতায় পরিযায়ন করা এই মানুষগুলোর অধিকাংশেরই ঠিকানা মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার বাঁশচেতর গ্রাম। তবে সেই গ্রাম ঢাকিগ্রাম হিসাবেই অধিক পরিচিত। শুধু যে কলকাতাতেই পুজোর আমেজ তৈরি করতে ডাক আসে তাঁদের, এমনটা একেবারেই নয়। বরং প্রবাসী পুজোও তাঁদের ছাড়া অচল। “প্রতিবছরই এই সময়টা থাকি দেরাদুনে। গত সতেরো বছর ধরেই ওখানে ঢাক বাজাই। এবছর পুজোর কয়েকদিন আগেই ওখান থেকে জানানো হয়, করোনা পরিস্থিতির জন্য ঢাকের বন্দোবস্ত করা হচ্ছে না”, জানালেন স্বপন দাস। 

এই গ্রামের কিছু ঢাকিদের কর্মসংস্থান হলেও স্বপনবাবুর মতো অধিকাংশ মানুষের কাছেই আসেনি বায়না। কিন্তু এই চারটে দিনের ওপরেই মূলত নির্ভর করে থাকে সারা বছরের আয়ের একটা বড়ো অংশ। “এর পরেও অন্যান্য পুজো আছে। তবে সেখানে সেইভাবে সবার তো সুযোগ আসে না”, বলছিলেন স্বপনবাবু।

হিসাব মতো প্রায় আটমাস ধরে বন্ধ উপার্জন। সবথেকে বড় উৎসবেও খুলল না ভাগ্যের চাকা। কীভাবে চলছে তাঁদের সংসার? স্বপনবাবুর কথায়, “সামান্য দু’-একটা চাষ করেছি। তাতে যতটুকু হয়। আর তার বাইরে টাকা ধার করতে হয়েছে সংসার চালানোর জন্য। সুদও দিতে হবে তাতে। তবে এই বছরটা যদি উতরে যায়। পরের বছরে স্বাভাবিক হলে আবার নয় উপার্জনের মুখ দেখা যাবে।”

আরও পড়ুন
সিনেমায় দুর্গাপুজো; বাঙালির ‘শ্রেষ্ঠ’ উৎসবকে যেভাবে দেখেছেন সত্যজিৎ রায়

ডাক বাজানো ছাড়াও খোল, তবলার একটি দোকান রয়েছে স্বপনবাবুর। কিন্তু তাও এই পরিস্থিতিতে অচল ফুটে উঠল স্বপনবাবুর কণ্ঠে, “লকডাউনে গান-বাজনাই যখন সব বন্ধ, তখন আর কে খোল-তবলা সারাতে আসবে। একরকম বসে বসেই দিন কাটিয়েছি সেই সময়টায়।” 

ক্রমশ কঠিন থেকেই কঠিনতর হয়েই চলেছে তাঁদের পরিস্থিতি। মাথায় ঋণের বোঝা। এমন অবস্থাতেও এগিয়ে আসেনি কেউ। কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও পৌঁছায়নি তাঁদের কাছে। আর সরকারি সাহায্য তো দূরের কথা। তবে বহুদিনের পরিচয় থাকার জন্য দেরাদুনের সেই পুজোর কর্মকর্তারা আশ্বাস দিয়েছেন, পুজো মিটলে সামান্য সাহায্য পাঠাবেন স্বপনবাবুকে। তবে বাকিদের হয়তো সেটাও জোটেনি ভাগ্যে। 

পুজোর বহুদিন আগে থেকেই আমাদের মধ্যে শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতি পর্ব। জামা-কাপড় কেনা থেকে শুরু করে সবকিছুই গুছিয়ে রাখা হয় উৎসবের জন্য। তবে ঢাকিদের কাছে এই রুটিন একটু অন্যরকমই। দেবীর ভাসান হওয়ার পরই তাঁরা মুখ দেখেন উপার্জনের। বাড়ি ফিরে সন্তানের হাতে তুলে দেন রঙিন শার্ট কিংবা কামিজ। কিন্তু এবছর সেই সুযোগও নেই। দেবীও কি মুখ ঘুরিয়েই নিয়েছেন তাঁদের থেকে?

আরও পড়ুন
দুর্গার পাশেই বঙ্গবন্ধুর ছবি, ১৯৭১-এর পুজো ও এক মুসলমান ‘দেবতা’র গল্প

Powered by Froala Editor

More From Author See More