ব্যাপক আর্থিক সংকট, ভারতীয় মধ্যবিত্তদের দুর্দশার ছবি উঠে এল সাম্প্রতিক সমীক্ষায়

দেশজুড়ে করোনা ভাইরাসের আক্রমণ সামলে উঠতে সার্বিক লকডাউন রাস্তাতেই হাঁটতে হয়েছিল ভারতকে। তারপর থেকে বরাবরই সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে সারা পৃথিবীর মধ্যে ভারতেই সবথেকে কঠোরভাবে পালিত হয়েছে লকডাউন। লকডাউনের ফলে প্রাথমিকভাবে করোনা ভাইরাসের আক্রমণ সামাল দেওয়া গিয়েছে বলে মনে করা হলেও আদতে তার সুফল যেমন এখনও দেখা যাচ্ছে না রোজ বাড়তে থাকা আক্রান্তের পরিসংখ্যানে, তেমনই এর কিছুদিন পর থেকেই গাঢ় হতে শুরু করেছে আরও একটি ভয় পাইয়ে দেওয়া ছবি। দীর্ঘস্থায়ী লকডাউনের ফলে কর্মক্ষেত্র সংকুচিত হতে শুরু করেছে ক্রমশ এবং তার ফলশ্রুতি হিসেবে দেখা যাচ্ছে একটি নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক শ্রেণীর মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আর্থিক ভাবে।

অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি (সিএমআইই)-এর সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ২০২০ সালের এপ্রিল-জুনে, অর্থাৎ লকডাউনের মাসগুলিতে প্রায় সমস্ত ভারতীয় আয়ের দিক থেকে সমূহ ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে। তবে এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের, দেখা গেছে সমীক্ষায়।

সিএমআইই এই সমীক্ষায় যে বিশেষ পদ্ধতি বা মেট্রিক ব্যবহার করেছে, তা হল সেই পরিবারগুলির তুলনা করা, যাদের বাৎসরিক আয় প্রতি বছর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই পদ্ধতিতে এক বছর আগের অর্থাৎ ২০১৯-এর এপ্রিল-জুন মাসের সঙ্গে বর্তমান বছরের এপ্রিল-জুন মাসে পরিবারগুলির আয়ের তুল্যমূল্য অনুপাত বিচার করেই এই সমীক্ষায় এগোনো হয়।

সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে, মাসিক ৪,০০০ বা বার্ষিক ৪৮,০০০ টাকা রোজগার ছিল যাদের, তাদের কারুরই আয় বৃদ্ধি পায়নি লকডাউনের মাসে। ২০১৯ সালের এপ্রিল-জুন মাসে, প্রতি বছর অন্তত পাঁচ লক্ষ টাকা আয় করা অর্ধেকেরও বেশি পরিবারের আগের বছরের তুলনায় আয়ের বৃদ্ধি হয়েছিল। চলতি বছরে লকডাউনের সময় এই আয়ের ঘাটতি হয়েছে অন্তত ১৫ শতাংশ। বার্ষিক ১০ লক্ষ টাকা অন্তত আয় করত যে সংখ্যক পরিবার, রেখচিত্রের নিচের দিকে নেমেছে সেই সংখ্যা। আয় ঘাটতির এই প্রবণতা কপালে ভাঁজ ফেলেছে অর্থনৈতিক উপদেষ্টাদের। সরাসরি এর প্রভাব পড়েছে বাজারেও।

অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়িয়ে দিয়েছে এই লকডাউন, মত তাঁদের। সমীক্ষাতেও স্পষ্ট হয়েছে সেই ছবি। 'এলিট' ধনী সম্প্রদায়ের আয় অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে এই সময়ে। বার্ষিক অন্তত ৩৬ লক্ষ টাকা আয় যে সকল পরিবারের, তাদের অন্তত অর্ধেকের ক্ষেত্রে লক্ষ্মীর আশীর্বাদ হয়ে এসেছে লকডাউন। এই সকল পরিবারের আয় বৃদ্ধি ইঙ্গিত করেছে সেই দিকেই। যদিও আয় বৃদ্ধির এই হার কোনও কোনও ক্ষেত্রে গত বছরের তুলনায় কম বলে দেখা গেছে।

এর সঙ্গেই আরও একটি পরিসংখ্যান বলছে, সামগ্রিকভাবে আয়বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জনসংখ্যার অনুপাত নেমে এসেছে ৩৩ শতাংশ থেকে ৬.৭ শতাংশে। প্রায় দুই লাখেরও বেশি পরিবারের উপর করা এই সমীক্ষায় সামনে এসেছে এই সময়ের আর্থিক দৈন্যতার বাস্তব ছবিটিও। লকডাউনের সময়েই দেশের চাকুরিজীবীদের আর্থিক ঘাটতি সামাল দিতে ইপিএফও বা কর্মচারীদের চাকরিক্ষেত্র থেকে পাওয়া প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে সঞ্চিত অর্থ তুলে নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এই প্রভিডেন্ট ফান্ডের মাহাত্ম্য বা গুরুত্ব মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের কারুরই অজানা নয়। দেখা গেছে যে, ১৩% এরও বেশি পেনশন হোল্ডার এই সময়ে তাঁদের তহবিল প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ফলে টান পড়েছে সরকারি বিনিয়োগ তহবিলেও।

আরও পড়ুন
করোনার জেরে বেহাল মার্কিন অর্থনীতিও, এক সপ্তাহে বেকার ১৩ লক্ষ?

যদিও এই আয়ের ঘাটতি ধনী পরিবারদের কাছে ততটাও আশঙ্কার না হলেও, মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তদের কাছে তা অশনি সংকেতের মতোই। লকডাউনে কাজ হারানো মানুষের সংখ্যা বা আয়ের পরিমাণে ব্যাপক টান পড়া মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে উত্তরোত্তর। পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার ছবিও উঠে এসেছে বারবার। তবুও এই পরিস্থিতিতে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা ছিল সরকারের, তা নেওয়া হয়নি বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখেও শোনা গিয়েছিল আর্থিক প্যাকেজ কিংবা ছোটো সংস্থাগুলির পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তা, লকডাউন পরিস্থিতিতে কর্মীদের চাকরির সুরক্ষা নিশ্চিত করার মতো কথা। কিন্তু সেই উপদেশ যে কানে তোলেনি সরকার, তা দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট হচ্ছে প্রতিদিন। সেই পরিস্থিতিতে ধর্মস্থান নির্মানে শ'য়ে শ'য়ে কোটি টাকার খরচ আদৌ কতটা সমীচীন, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থেকেই যাচ্ছে।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
অর্থনীতি সচল রাখতে ছাড় গ্রামীণ শিল্পে, কলকারখানা আংশিক চালু এপ্রিলেই

More From Author See More