উদ্বাস্তু হয়ে আসা ভারতে, গুঁড়ো মশলার জোরেই রেখে গেলেন 'সাম্রাজ্য'

ভারতীয়দের কাছে, বিশেষ করে উত্তর ভারতে আজও গুঁড়ো মশলা বললেই মনে আসে এমডিএইচ। আর এমডিএইচ মানেই টেলিভিশনের পর্দায় সেই বিয়েবাড়ির দৃশ্য। নববধূর বাবার চরিত্রে লাল পাগড়ি পরা মানুষটিকে তো সবাই দেখেছেন। কিন্তু ক্যামেরার পিছনে সেই মানুষটি কে? ভাবতে অবাক লাগে, সেই মানুষটিই এমডিএইচ মশলার সর্বময় কর্তা মহাশয় ধরমপাল গুলাটি।

এমডিএইচের ব্যবসা তখন নতুন নয়। তবে দূরদর্শন নতুন এসেছে। আর তার জন্য বিজ্ঞাপন তৈরি করতে হবে। সবকিছু ঠিকঠাক। কিন্তু নববধূর বাবার চরিত্রে যাঁর অভিনয় করার কথা ছিল, তিনি বেঁকে বসলেন। যে মজুরি তিনি চাইলেন, তা দেওয়ার ক্ষমতা তখনও মহাশয়জির নেই। তাহলে উপায়? মজার ছলেই বিজ্ঞাপনের পরিচালক বললেন, কাজটা তাহলে তিনি নিজেই করুন না। কথাটা মজার ছলে বলা হলেও বেশ মনে ধরে গিয়েছিল ধরমপাল গুলাটির। আর শেষ পর্যন্ত তাই হল। কাজ শেষে মৃদু হেসে শুধু বলেছিলেন, “অনেকটা খরচ বেঁচে গেল”।

ভারতে বিজ্ঞাপনের জগতে খোদ কোম্পানির মালিকের আত্মপ্রকাশ সেই প্রথম। এরপর অবশ্য নানা বিজ্ঞাপনেই এমনটা দেখা যাবে। কিন্তু তাঁরা এসেছেন নিজস্ব চরিত্রেই। আর মহাশয় ধরমপাল এসেছিলেন একেবারে সাধারণ একটি চরিত্রে। এই চরিত্রের মধ্যেই তো খুঁজে পেয়েছিলেন নিজের শিকড়, নিজের ঐতিহ্য। সেই স্বাধীনতা তথা দেশভাগের সময় থেকে যে লড়াই শুরু হয়েছিল, সেটা তো সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠার লড়াই।

১৯২৩ সালে শিয়ালকোটে জন্ম মহাশয় ধরমপাল গুলাটির। প্রথম জীবন বেশ সুখেই কেটেছে। কিন্তু দেশভাগের পরেই দেখা গেল শিয়ালকোট পড়েছে পাকিস্তানে। অতএব এবার ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসার পালা। সীমান্ত পেরোনোর সময় পরিবারের হাতে ছিল মাত্র ১৫০০ টাকা। সেইটুকু সম্বল নিয়েই দিল্লি চলে আসা। আর তারপর বেঁচে থাকার লড়াই শুরু। রোজগারের জন্য প্রথমে টাঙ্গা চালাতে শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে ধরমপাল গুলাটির বাবা মহাশয় চুনীলাল গুলাটি কারোল বাগের আজমল খান রোডের উপর তৈরি করলেন একটি মশলার দোকান। সাধারণ দোকান যেমন হয়।

আরও পড়ুন
করোনায় প্রয়াত সরোদশিল্পী ওস্তাদ শাহদাত হোসেন খান

শুরুটা হয়েছিল এভাবেই। কিন্তু ধীরে ধীরে ব্যবসা এগিয়ে নিয়ে যেতে খুব বেশি সময় লাগল না। ‘মহাশিয়ান দি হাট্টি’ বা এমডিএইচ হয়ে উঠল দেশের গুঁড়ো মশলার প্রথম নাম। ব্যবসা ছড়িয়ে যেতে লাগল দেশের বাইরেও। আয়কর বিভাগের হিসাব বলছে উত্তর ভারতে মশলা ব্যবসার ৬০ শতাংশই ধরে রেখেছে এমডিএইচ। বর্তমানে সারা দেশে ১৮টি কারখানা আছে এমডিএইচের। আর ২০১৮-১৯ আর্থিক বছরে ব্যবসা থেকে মুনাফা হয়েছিল ২৫ কোটি টাকা। গতবছর দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার পদ্মভূষণ সম্মানে সম্মানিত হন দরমপাল গুলাটি। আর চুনীলাল গুলাটি ট্রাস্টের আওতায় এখন দিল্লি শহরের একটি ২৫০ শয্যার হাসপাতাল সহ আছে একটি স্পোর্টস অ্যাকাডেমি। মাত্র ১৫০০ টাকা থেকে কোটিপতি হওয়ার লড়াইটা সহজ ছিল না। এই পুরো লড়াইতে মাথার উপর ছিলেন মহাশয় ধরমপাল গুলাটি ওরফে দাদাজি। তবে বয়সের ভারে শরীর ভেঙেছে অনেকদিন। শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার সকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন দাদাজি। তবে দেশভাগের ইতিহাস বুকে নিয়ে আজও ব্যবসা চালিয়ে যাবে এমডিএইচ। স্বাদে-গন্ধে যা খাঁটি ভারতীয়।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
প্রয়াত ফুটবলের রাজপুত্র দিয়েগো মারাদোনা

More From Author See More