উচ্চমাধ্যমিক গণিতে ভয় কিংবা সাফল্যের কাণ্ডারী তিনিই, প্রয়াত অধ্যাপক এস. এন. দে

মাধ্যমিক পরীক্ষার পর অনেক ছাত্রছাত্রীই ভর্তি হয় বিজ্ঞান বিভাগে। আর বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো মানেই প্রথম আতঙ্কের বিষয় অঙ্ক। বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি তো আছেই; সেইসঙ্গে নতুন সংযোজন ক্যালকুলাস, স্থানাঙ্ক জ্যামিতি এবং সেট থিওরি। এই নিয়ে হিমশিম খেলেও কয়েক দশক ধরে পড়ুয়াদের ভরসা জুগিয়ে এসেছে একটিমাত্র বই। আর সেই বইয়ের লেখকের নাম সৌরেন্দ্রনাথ দে, ওরফে এস. এন. দে।

বইয়ের পাতার অসংখ্য জটিল অঙ্ক আর উদাহরণের মধ্যে আড়ালেই থেকে গিয়েছেন মানুষটি। আর এভাবেই আড়ালে থেকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন গণিতের এই শিক্ষক। গত ৬ আগস্ট রাত ১১টা বেজে ২০ মিনিটে সেরিব্রাল অ্যাটাকে মারা যান সৌরেন্দ্রনাথ দে। 

১৯৪৪ সালে শ্রীরামপুরের কালিতলা অঞ্চলে জন্ম সৌরেন্দ্রনাথ দে-র। পারিবারিক অবস্থা তেমন স্বচ্ছল ছিল না। কিন্তু ছোটোবেলা থেকেই পড়াশুনোর প্রতি, বিশেষ করে অঙ্কের প্রতি তার আগ্রহ সবাইকেই অবাক করেছিল। আর তাই নিজের মেধার জোরেই পড়াশুনো চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

প্রথমে শ্রীরামপুর ইউনিয়ন স্কুলে প্রাথমিক পড়াশুনো এবং তারপর শ্রীরামপুর কলেজ থেকে প্রি-ইউনিভার্সিটি স্তরের পড়াশুনো শেষ করে ভর্তি হন বিদ্যাসাগর কলেজে। সেখান থেকেই স্নাতক এবং তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিতে স্নাতোকত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। অতঃপর পিএইচডি করে যোগ দেন শিক্ষকতায়। দক্ষিণ কলকাতার হেরম্বচন্দ্র কলেজে (সিটি কলেজ) গণিত ও পরিসংখ্যান বিষয়ের অধ্যাপক ছিলেন তিনি। পাশাপাশি শিবনাথ শাস্ত্রী কলেজ এবং ব্যারাকপুরের মহাদেবানন্দ কলেজে আংশিক সময়ের অধ্যাপনা করেছেন সৌরেন্দ্রনাথ দে।

তবে কলেজের অধ্যাপনার সময়েও তাঁর মনে হত, গণিতশিক্ষার শুরুটা হওয়া উচিত মাধ্যমিক স্তরের পর থেকেই। বিশেষ করে এই সময়েই তো গণিতের নতুন নতুন প্রয়োগের সঙ্গে পরিচিত হয় পড়ুয়ারা। আর এইসময়েই তো অঙ্ক নিয়ে ভয় কাজ করে সবথেকে বেশি। তাই সেইসব পড়ুয়াদের জন্যই লেখা হল একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর বই। তবে শুধু বই লেখাই নয়, মেধাবী পড়ুয়াদের নিজের দায়িত্বে পড়ানোর দায়িত্বও নিতেন তিনি। এমনকি তাঁর ছাত্রছাত্রীদের কাছে জানা গিয়েছে, অনেক পড়ুয়াকে নাকি বিনা পারিশ্রমিকেও গাইড করেছেন তিনি। বৈদ্যবাটি শহরের একেবারে আপনজন হয়ে উঠেছিলেন এই দিলখোলা মানুষটি।

প্রতিবেশীদের কথায়, জীবনে কোনোরকম আড়ম্বর পছন্দ করতেন না এস. এন. দে। তবে তিনি যে কৃপণ মানুষ ছিলেন, তাও নয়। পাড়ার দুর্গাপুজোয় একবার প্রত্যেকের ভুরিভোজের আয়োজন করেছিলেন তিনি নিজেই। কিন্তু জীবনযাপন ছিল একেবারেই সাদামাটা। গণিতের ‘বেস্ট সেলার’ বইয়ের লেখক হয়ে তিনি হয়তো অনেক জায়গাতেই প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন। কিন্তু এধরনের চতুরতার আশ্রয় নেননি কোনোদিন। সারাদিন অঙ্ক নিয়েই মেতে থাকতেন। সেখানেই তাঁর নেশা।

আরও পড়ুন
প্রয়াত অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্য হারাল আরও এক নক্ষত্রকে

শেষ জীবনটা অবশ্য বেশ একাকিত্বের মধ্যেই কাটিয়েছেন। স্ত্রী’র মৃত্যু তাঁকে বেশ কাবু করেছিল। আর তার কিছুদিন পরেই খাদ্যনালিতে ক্যানসার ধরা পড়ে তাঁর। তবে যতদূর জানা গিয়েছে, ক্যানসারে মৃত্যু হয়নি তাঁর। মৃত্যু হয়েছে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। কিন্তু লেখক সশরীরে না থাকলেও তাঁর লেখা বই থেকে যাবে। সেইসব বই আগামী দিনেও পড়ুয়াদের গণিত শিখতে সাহায্য করবে। তবে তাঁর অদ্ভুত প্রতিভার কথা হয়তো অনেকেই জানতে পারবেন না। কেবল যে গুটিকয় পড়ুয়া তাঁর কাছে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা জানেন কীভাবে কোনোরকম খাতা-পেন ছাড়াই মুখে মুখে জটিল সমস্যার সমাধান করে দিতে পারতেন সৌরেন্দ্রনাথ দে। অঙ্কই যে ছিল তাঁর নিকট সঙ্গী।

Powered by Froala Editor

More From Author See More