'আমার প্রার্থনার রাম, দশরথপুত্র ও অযোধ্যার রাজা সেই ঐতিহাসিক রাম নন', বলেছিলেন গান্ধীজি

তিনি নিজে পারিবারিক সূত্রে, এবং ব্যক্তিগতভাবে হিন্দুধর্মের মানুষ ছিলেন, এ কথাই ইতিহাস বলে। কিন্তু নিজের ধর্ম বলতে তিনি নিছক হিন্দুত্ব বুঝতেন না। ধর্ম প্রসঙ্গে গান্ধীজি বলেছেন, 

"অন্য সব ধর্মের চেয়ে যাকে আমি শ্রেয়তর বলে মনে করি, সেই হিন্দুধর্ম নয়, বরং তা হল হিন্দুধর্ম অতিক্রমী এক ধর্ম যা মানুষের চরিত্র পালটে দেয়, অন্তরের সত্যের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যরূপে মানবকে জড়ায়, এবং সদ্য পবিত্র করে। সেই ধর্ম হল মানবচরিত্রের এক অবিনাশী অংশ, যা পূর্ণতা লাভের পথে যে কোনও মূল্য দিতে রাজি।" তাঁর মনে সদা জাগরুক ছিল গভীর বিশ্বাস - আসুরিক শক্তির দ্বারা কোনও ধর্মকেই ধরে রাখা যায় না। তিনি বলেছেন, "যারা অসি ধারণ করে, তারা চিরকাল অসির আঘাতেই মরে।"

বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও বিরোধ গান্ধীজির একেবারেই না-পসন্দ ছিল। তিনি সমন্বয়বাদের সুরে বলেছেন, "ধর্ম হল বিভিন্ন পথ, যা একই গন্তব্যে উপনীত হয়। যদি আমরা একই গন্তব্যে পৌঁছই, তাহলে ভিন্ন ভিন্ন পথে হাঁটলে ক্ষতি?" আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক একাধিপত্যের বিরুদ্ধে গান্ধীজি বলেছেন, "আমি এ-বিশ্বাসের অংশীদার নই যে, পৃথিবীতে একটিমাত্র ধর্মই আছে, বা থাকবে।" যেমন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে, তেমন দেশের ক্ষেত্রেও তাঁর ধারণা একই। গান্ধীজি বলেন, "আমি চাই না যে আমার স্বপ্নের ভারত একধর্মাবলম্বী, অর্থাৎ সম্পূর্ণ হিন্দু, বা খ্রিস্টান বা মুসলমান হয়ে উঠবে। আমি চাই, ভারতে সহিষ্ণুতা বিরাজ করবে, এর বিভিন্ন ধর্ম পাশাপাশি কাজ করবে।" কারণ? কারণ তাঁর ঐকান্তিক বিশ্বাস ছিল, "মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির জন্য নানা ধর্ম নয়, এদের লক্ষ্য মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা।" 

ছাত্রসমাজে ধর্মশিক্ষা দেবার ব্যাপারে গান্ধীজি জোর দিয়েছিলেন, কিন্তু এ ব্যাপারে রাষ্ট্রশক্তির হস্তক্ষেপের বিরোধী ছিলেন তিনি। তিনি বলেছেন, "ধর্মীয় শিক্ষা বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাবার বা এর ব্যবস্থা করার কোনও দরকার রাষ্ট্রের আছে বলে আমি মনে করি না। আমার মতে ধর্মশিক্ষার বিষয়টি ধর্মীয় সংঘগুলির অধীনে চলাই ভালো।" এবং, এই ধর্মশিক্ষা কেবল একটিমাত্র ধর্মের কথা জানাই নয়, অন্যান্য ধর্মের মূলনীতিগুলি সম্পর্কেও ছাত্রদের অবহিত করতে হবে, এই ছিল তাঁর মত। গান্ধীজি বলেছেন, "নিজস্ব ধর্ম ছাড়াও অন্যান্য ধর্মের কিছু সূত্রও ধর্মশিক্ষার পাঠক্রমে থাকা একান্ত দরকার। এই উদ্দেশ্যেই ছাত্রদের শ্রদ্ধা ও উদার সহিষ্ণুতাসহ বিশ্বের বিভিন্ন মহান ধর্মের সারবাক্য বোঝার ও উপলব্ধি করার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।"

ঈশ্বর কে, বা কী? এই সম্পর্কে গান্ধীজির মত ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, "আমি ঈশ্বরকে কোনও ব্যক্তি মনে করি না। সত্য আমার কাছে ঈশ্বর।" ঈশ্বরের সর্বমঙ্গলময়তা বিষয়ে তাঁর বক্তব্য: "যা সর্বশুভ, তাই হল ঈশ্বর।" অথচ, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তো বিশেষভাবে রাম-উপাসক ছিলেন, এ কথা সকলেই জানে। নিজের রামভক্তির বিশেষ চরিত্রটিকে স্পষ্ট করে তোলার জন্য তাই মহাত্মাকে বলতে হয়েছে, "আমার রাম, আমার প্রার্থনার রাম, দশরথপুত্র ও অযোধ্যার রাজা সেই ঐতিহাসিক রাম নন। এই রাম হলেন চিরন্তন, যিনি অজাত এবং অদ্বিতীয়। একমাত্র তাঁকেই আমি পূজা করি।" 

শৈশব থেকেই পৈতৃক বাড়ির নিকটস্থ রামজীর মন্দিরে যেতেন তিনি। বহু ভয় ও বহু পাপ থেকে রাম তাঁকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করে চলেছেন, এই ছিল তাঁর বিশ্বাস। ছোটোবেলায় তাঁর পরিচারিকা তাঁকে শিখিয়েছিলেন, কখনও ভয় পেলে বা মনখারাপ হলে রামনাম করতে। সেই থেকে রামনাম তাঁর নিত্য অভ্যাসের অন্তর্গত। তিনি বলেছেন, "এই নামই আমার রক্ষাকর্তা এবং সেই থেকে আমি এই নাম আঁকড়ে রয়েছি।" তবে, ঈশ্বরবাচক অন্য কোনও নাম সম্পর্কেই কোনও নঞর্থক ধারণা তাঁর ছিল না। তিনি বলেছেন, "যে নামটিই ভালো লাগে, সে নামেই আমরা তাঁকে পূজা করতে পারি, - প্রার্থনা জানাতে পারি। কেউ তাঁকে বলে রাম, কেউ কৃষ্ণ, আবার কেউ বলে রহিম, অন্যেরা বলে 'গড'।" 

আরও পড়ুন
প্রতি সন্ধ্যায় গড়ের মাঠে আড্ডা জমাতেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, ‘ময়দান ক্লাবের আড্ডা’ নাম দিলেন গান্ধীজি

তিনি নিজে কেন বিশেষভাবে আকৃষ্ট হলেন রামনামের প্র‍তি? 

এ সম্পর্কে গান্ধীজি বলছেন, "আমি সত্যকে রাম নামে ডাকি। জীবনপরীক্ষার গাঢ় অন্ধকার মুহূর্তে ওই একটি নামই রক্ষা করেছে আমাকে, এখনও রক্ষা করে চলেছে। হয়তো এর কারণ আমার শৈশবের অভিজ্ঞতা, হয়তো তুলসীদাস-পাঠের মুগ্ধতা।" 

মহাত্মা তুলসীদাস রচিত 'শ্রীরামচরিতমানস' মহাগ্রন্থটির প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা। তিনি বলেছেন, "বিশ্বের আধ্যাত্মিক সাহিত্যে তুলসীদাসের রামায়ণের স্থান খুবই উঁচুতে। এর মধ্যে যে সৌন্দর্য রয়েছে তা আমি মহাভারতে, এমন কি বাল্মীকির রামায়ণেও পাই না।" সেইসঙ্গে, অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের মধ্যেও তিনি খুঁজে পেয়েছেন শান্তির রসদ। 'ভগবদগীতা' তাঁর কাছে মাতৃতুল্য, গীতার মাহাত্ম্য সম্পর্কে তিনি বলেন, "যখনই আমি বাধার সম্মুখীন হই, তখনই আমি মাতৃসমা 'গীতা'র কাছে ছুটে যাই। তিনি আমাকে সান্ত্বনা দেননি, এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি।" আবার একইসঙ্গে, কোরানের প্রতিও তিনি শ্রদ্ধাবান। গান্ধীজি জানিয়েছেন, "'কোরান' আমার কাছে এক ঈশ্বর-আদিষ্ট ধর্মগ্রন্থ এবং মহম্মদ আমার কাছে পয়গম্বর।" 

আরও পড়ুন
মুখে ‘মহাত্মা গান্ধী কি জয়’ স্লোগান, চট্টগ্রাম স্বাধীন করলেন মাস্টারদার অনুগত বিপ্লবীরা

নিজে হিন্দু হয়েও, কীভাবে তিনি সকল ধর্মমতের প্রতি শ্রদ্ধাবান হতে পেরেছিলেন? এর উত্তর জানিয়েছেন গান্ধীজি নিজেই। 

"আমার হিন্দুধর্ম সংকীর্ণ নয়। ইসলাম-খ্রীস্ট-বৌদ্ধ-জরাথুস্ত্রীয় ধর্মের মধ্যে যা কিছু আমি ভালো বলে জানি, তা আমার হিন্দুধর্মে আছে... সত্য হচ্ছে আমার ধর্ম এবং অহিংসা হল এর বাস্তবায়নের একমাত্র পথ।" এই হচ্ছে গান্ধীজির অভিমত। তরবারির সাহায্যে ধর্মপ্রচার তাঁর কাছে বিষবৎ, অহিংসাই তাঁর কাছে সুধাস্বরূপ।

মৌখিকভাবে ধর্মধ্বজী কিন্তু কার্যক্ষেত্রে অধর্মপন্থী যারা, তাদের বিরুদ্ধে গান্ধীজির বাক্য নির্ভীক, বজ্রবৎ। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, "যাদের মুখে মধু, অন্তরে বিষ, তাদের কথা তিনি শোনেন না। কাজেই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে হলে অন্তর শুদ্ধ করতে হবে।" দ্বিচারিতায় পূর্ণ ধর্মধ্বজীদের উদ্দেশে তাঁর কঠোর উচ্চারণ- "মুখে রামনাম জপ করা ও কাজে রাবণের পথে চলা ফলপ্রসূ তো নয়ই বরং অনেক বেশি ক্ষতিকারক। এটা নিছক ভণ্ডামি। নিজেকে বা বিশ্বকে ভাঁওতা দেওয়া যায়, সর্বশক্তিমানকে প্রতারিত করা যায় না।"

আরও পড়ুন
চাইছি বলেই আমরা পরাধীন, গান্ধী-দর্শন প্রত্যাখ্যানের ফল কি ভুগছি আমরা?

"মানুষ যদি ঈশ্বরকে অনুসরণ করত, তাহলে বর্তমানে এই বিশ্বজোড়া দুর্নীতি ও মুনাফাবাজি আমাদের দেখতে হত না।" - বলেছেন মহাত্মাজী। আজকের দুনিয়ায় ধনী ক্রমেই আরো ধনী হচ্ছে, আর দরিদ্ররা হয়ে উঠছে দরিদ্রতর। চারদিকে তাণ্ডব চালাচ্ছে ক্ষুধা, নগ্নতা আর মৃত্যু। গান্ধীজি বজ্রগর্জনে বলেছেন, "এ-সব ঈশ্বরের রাজ্যের লক্ষণ নয়। এ হল রাবণ ও শয়তানের হুকুমত। কেবল ঈশ্বরের নাম মুখে আউড়ে আমরা বিশ্বে তাঁর রাজত্ব স্থাপন করতে পারব না। আমাদের কাজকর্মকেও শয়তানের বদলে ঈশ্বরের অনুগামী করে তুলতে হবে।" 

ধর্মীয় বিদ্বেষের ভিত্তি হচ্ছে সাম্প্রদায়িক নিয়মকানুনের পার্থক্য। কিন্তু গান্ধীর মতে, এ সকল পার্থক্য নিতান্তই বাহ্যিক। তিনি সমন্বয়ের বাণী: "মন্দির বা মসজিদ বা গীর্জা... ঈশ্বরের নিবাস হিসেবে এদের মধ্যে কোনও পার্থক্য আমি করি না। ধর্মবিশ্বাসই তাদের ওই ভাবে গড়েছে। এগুলি হল অ-দৃশ্য যিনি, তাঁর কাছে পৌঁছনোর জন্য তৃষাতুর মানুষের আর্তি।" 

পাথরের বাড়ি নয়, তাঁর কাছে ঈশ্বরের যথার্থ মন্দির ছিল মানবদেহ। তাই, শ্রেষ্ঠ উপাসনাক্ষেত্রের ধারণা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, "সম্মিলিত উপাসনার শ্রেষ্ঠ স্থান হল ফাঁকা জায়গা, যেখানে মাথার ওপরে আকাশের চাঁদোয়া ও নিচে মেঝের মতো জননী বসুন্ধরা।" আর কী হবে, সেই উপাসনার মন্ত্র? তাও বলেছেন মহাত্মাজী-

"আমি ঐহিক ক্ষমতা চাই না, স্বর্গেও যেতে চাই না, এমন কি নির্বাণলাভও আমার অভীষ্ট নয়। আমি শুধু চাই, যারা কষ্টে আছে, তাদের কষ্ট লাঘব করতে।" 

মহাত্মাজীর দেখানো পথে, মানুষের কষ্ট লাঘবই হোক আধুনিক ভারতের ধর্ম, ভারতবাসীর জীবনব্রত। 

তথ্যসূত্র: 

'গান্ধী-মানস', মহাশ্বেতা দেবী অনূদিত।

ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইণ্ডিয়া।

Powered by Froala Editor