লকডাউনের গপ্পো ২

হাই অনুত্তমা।

হেল্লো শান্তনু।

আপনি যে আমাকে রিপ্লাই দেবেন আমি ভাবতেই পারিনি।

কেন? আমি রিপ্লাই দিতে পারি না?

না না তা কেন? আসলে আপনি তো সেলিব্রিটি।

হাসালেন। আমি মোটেই সেলিব্রিটি নই।

একশোবার সেলিব্রিটি। আমজনতা যাকে নিয়ে সেলিব্রেট করে সেই সেলিব্রিটি। আপনার সব পোস্টে হাজার-দেড় হাজার লাইক। হাজার হাজার ফলোয়ার। আপনার জন্মদিনে কত মানুষ আপনার ছবি এঁকে উপহার দেয়। তা ছাড়া কী ভাল গান করেন আপনি! আপনার চারপাশে নিশ্চয়ই সারাক্ষণ রূপমুগ্ধ, গুণমুগ্ধ মানুষের ভিড় লেগে থাকে। সেখানে আমার মতো সাদামাটা মানুষকে আপনি রিপ্লাই দেবেন না এটা ভাবাই তো স্বাভাবিক। তাই নয় কি?

বুঝলাম।

কী বুঝলেন?

এই যে আপনি আমায় স্টক করেন।

তা করি। আপনার গান শুনি। বড় মায়া আপনার গলায়।

শুধুই গান শোনেন? আমার ছবি দেখেন না? আপনার কি আমাকে দেখতে ভাল লাগে না?

এ মা! না না। আপনি তো অসম্ভব সুন্দরী। সত্যি বলতে কি আপনার মতো সুন্দরী আমি বিশেষ দেখিনি। কিন্তু তার পরেও বলব, আপনার গান শোনার জন্যই আমি আপনার প্রোফাইলে যাই। আসলে কাকে কেমন দেখতে তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।

আরও পড়ুন
লকডাউনের গপ্পো ১

কেন? আপনার কি মনে হয় না সুন্দর দেখতে হওয়াটা একটা কোয়ালিফিকেশন?

হ্যাঁ। ওই সিরিয়াল সিনেমায় চান্স পাওয়া যায়।

ব্যাস?

তা ছাড়া ওই অনেকে পাত্তাটাত্তা দেয়। এর বেশি তো আর কিছু না।

ভুল ধারণা। সুন্দর দেখতে হওয়ার কত সুবিধে আপনি জানেন?

না। আমি অত্যন্ত সাধারণ দেখতে। ভিড়ের এক জন। সুন্দর দেখতে হওয়ার সুবিধে কী করে জানব বলুন?

হুম। আসলে কী জানেন, সুন্দর দেখতে হওয়ার অনেক অসুবিধে। অসুবিধেই বেশি।

হতে পারে। বললামই তো আমি গড়পড়তা এক জন মানুষ। সুন্দর দেখতে হওয়ার সুবিধে বা অসুবিধে কোনওটাই আমার জানার কথা নয়।

বেশ। আমি বলছি। শুনুন। সৌন্দর্য আপনার অন্য কোয়ালিটিগুলোকে ঢেকে দেয়। বিশেষ করে মেয়েরা যদি সুন্দর দেখতে হয় তা হলে তো কথাই নেই। পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করলে সহপাঠীরা বলবে, 'ওকে দেখতে ভাল। মুখ দেখে নম্বর দিয়েছে।' ভাল চাকরি পেলে পড়শিরা বলবে, 'ও কি আর এমনি পেয়েছে? দেখো না কেমন ঠোঁট টিপে হাসে, গা মুচড়ে মুচড়ে কথা বলে! রূপ দেখিয়ে কাজ পেয়েছে।' প্রমোশন পেলে কলিগরা বলবে, 'কাজের তো জানে ঘণ্টা। বসকে ভেতরে ঢুকিয়ে রেখেছে। প্রমোশন তো হবেই।' পারডন মাই ল্যাঙ্গোয়েজ।

না না ঠিক আছে।

কিচ্ছু ঠিক নেই। ছোটবেলা থেকে সুন্দর সুন্দর শুনতে শুনতে আমার কান পচে গেছে। এখন কেউ সুন্দর বললেই আমার মাথা গরম হয়ে যায়৷ ভাগ্যিস আপনি আমার গান নিয়ে কথা বললেন। নয়তো এতক্ষণে আপনাকে ব্লক করে দিতাম।

যা মনে হয়েছিল ঠিক তাই। আপনি খুব রাগী। সে জন্যই মেসেজ করতে ভয় পেতাম।

ঠিক। আমি খুব রাগী৷ কিন্তু এই মেসেজ করার ভয়টা জয় করলেন কী করে?

লকডাউন।

আমার স্ত্রীর প্রথম থেকেই একটা রেসপিরেটরি প্রবলেম ছিল। তা এই লকডাউনের দিন তিনেক আগে হঠাৎই জ্বর, গলা ব্যথা, শ্বাসের কষ্ট শুরু হল। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম সাধারণ ফ্লু। কিন্তু পরে আর সাহস পেলাম না। ঠিক করলাম ওকে হসপিটালে নিয়ে যাব৷ নীচে উবার এসেছে। আমি সিড়ি দিয়ে নামছি, ও আমার পেছনে। আচমকা পা স্লিপ করে ও পড়ে গেল। এক্সরে করে দেখা গেল কোমর ভেঙে গেছে। ঠিক হল দু'দিন পর অপারেশন। কিন্তু অপারেশনের দিন ডাক্তাররা আমাকে জানালেন, ইতিমধ্যেই করোনা ওর ফুসফুস দুটোই ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। অপারেশনের ধকল ও আর নিতে পারবে না৷

হোয়াট? তার পর?

আরও পড়ুন
পোকার আক্রমণে ধ্বংস হবে ইতালি, ভাইরাস দিয়েই তা ঠেকালেন বাংলার ঘনাদা

ততক্ষণে গভর্নমেন্ট আমাকে কোয়ারেন্টাইনে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমি অনেক অনুরোধ করেছিলাম, শেষ সময়টায় কি আমাকে ওর কাছে থাকতে দেওয়া যায় না? না আমি শেষবেলায় ওকে বিদায় বলতে পারিনি। বলতে পারিনি, আবার দেখা হবে। আমি ফোনে খবর পেয়েছিলাম, ও আর নেই। আমি হয়তো পাগল হয়ে যেতাম যদি আপনার গান না থাকত।

যে দিন ওর চলে যাওয়ার খবর পেলাম সে দিন সন্ধেবেলায় আপনি গাইলেন, 'ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু।' আমি কতবার যে গানটা শুনেছি মনে নেই। কান্না পেলেই আমি গানটা শুনতাম। আপনি গাইতেন, 'এই যে হিয়া থরোথরো/ কাঁপে আজি এমনতরো/ এই বেদনা ক্ষমা করো প্রভু।' আমি শক্তি পেতাম। বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পেতাম। তাই ভাবলাম আপনাকে এটা জানানো দরকার।

আমার খুব কষ্ট হচ্ছে জানেন? আপনাকে একটা সত্যি কথা বলব? খুব ইচ্ছে করছে বলতে।

বলুন।

ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে আমার যে ছবিগুলো দেখতে পান সেগুলো একটাও আমার এখনকার ছবি না। তিন চার মাস আগের। আমার এখনকার ছবি দিলে একটাও লাইক পড়বে না।

কী বলছেন? আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।

আসলে তিন মাস আগে আমার অ্যালোপেশিয়া ধরা পড়ে। হু হু করে চুল উঠতে থাকে। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। লাভ হয়নি। ডাক্তাররা বলেছেন, এর কিওর খুব স্লো। কয়েক বছর লেগে যাবে সারতে। নাও সারতে পারে। এখন আমার মাথায় কোনও চুল নেই। ভুরুতেও নেই বললে চলে। আমাকে এখন কদাকার দেখতে।

এ তো অসুখ। মন খারাপ করবেন না প্লিজ।

মজার ব্যাপার কী জানেন? যেই আমাকে খারাপ দেখতে হয়ে গেল আমার প্রেমিক বোকা বোকা অছিলায় ব্রেক আপ করে ফেলল। যে সব ছেলেরা আমাকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনত তারাও রাতারাতি পাত্তা দেওয়া বন্ধ করে দিল। পড়শিরা মুখ টিপে হাসতে লাগল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। এই যে আপনি আমায় সেলিব্রিটি বলছিলেন, সে তো আমার রূপের জন্যই। আমিও তো এনজয় করতাম ওটা। সেই রূপই যদি না থাকে কেউ তো আমার দিকে ফিরেও তাকাবে না৷ তাই সোস্যাল মিডিয়ায় পুরনো ছবিগুলোই দিতাম। এই লকডাউন হতে বড় শান্তি পেয়েছিলাম জানেন? সবাই যখন লকডাউন হয়েছে বলে হাহাকার করছে তখন আমি নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম, যাক আর তো বেরতে হবে না বাড়ি থেকে। মানুষকে মুখ দেখাতে হবে না। প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে না। ঘরে বসে পুরনো ছবি আপলোড করতে করতে আমি একটা মিথ্যে জীবনে বাঁচছিলাম। হয়তো ডিপ্রেশনেই চলে যেতাম। আপনি বাঁচিয়ে দিলেন।

কী ভাবে?

আপনি বললেন বলেই তো বুঝতে পারলাম, রূপ ছাড়াও আমার গান আছে। আমার একজিস্ট্যান্স আছে।

কী জানেন অনুত্তমা, সব হারিয়ে যায় শুধু থেকে যায় গান।

ঠিক বলেছেন। অনেকটা কনফিডেন্স দিলেন আমায়। লকডাউন উঠলে একদিন কফি খেতে যাবেন?

যাব। একটা কথা বলবেন?

বলুন।

অ্যালোপেশিয়া না হলে আমায় রিপ্লাই দিতেন?

মনে হয় না।

কফি খাওয়ার পরে কিন্তু গান শুনব।

কপি দ্যাট।