বাংলা সাহিত্যে স্পর্ধার খোঁজ, আলোচনায় ছ'টি সাম্প্রতিক লিটল ম্যাগাজিন

বইমেলার দশমী নিশি প্রায় চলে এসেছে। মন খারাপ ঢুকতে শুরু করেছে বইপ্রেমীদের মধ্যে। তা সত্ত্বেও শেষ মুহূর্তের উন্মাদনার ভাগ নিতে তৈরি সবাই। তৈরি লিটল ম্যাগাজিনও। এই বইমেলার বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিনের আলোচনা নিয়ে হাজির হয়েছি আমরা। প্রহরের এই পর্বে থাকছে আরও কিছু পত্রিকার কথা—

একশো আশি ডিগ্রি

‘শ্মশান একটি সশরীরী অস্তিত্ব যেখানে আমরা অশরীরী হয়ে যাই।’ যত জীবন এগোয়, ততই মৃত্যু ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগোতে থাকা। চুল্লির আঁচই হোক, বা দাফনের মাটি— শরীরে নিয়ে কি বয়ে বেড়াই না আমরা? ‘একশো আশি ডিগ্রি’-র সাম্প্রতিক সংখ্যা এমনই বিশেষ শ্মশান সংখ্যা।

এই সংখ্যার সেই অর্থে কোনো সম্পাদকীয় নেই। স্বয়ং সম্পাদক অভিষেক চক্রবর্তী বলেই দিচ্ছেন, ‘শ্মশানের কোনো সম্পাদনা হয় নাকি!’ ঠিকই তো, দিনের শেষে শ্মশানই তো গন্তব্য সবার। এই সংখ্যা করার আশেপাশের সময় এক এক করে চলে যান প্রিয় মানুষগুলো। তাঁরাও কি জড়িয়ে নেই এখানে? সম্পাদকের কলমে উঠে এসেছে সেই সব মুহূর্ত। তখন তিনিও শ্মশানচারী…

গোটা সংখ্যা জুড়ে আছে গদ্য, প্রবন্ধ, ব্যক্তিগত কথা। সব কিছুর ওপর ছাই জমে আছে যেন। মৃত্যুকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে উঠছে এইসব লেখা। খুব ভারী ভারী কথা হয়ে গেল কি? হয়তো। কিন্তু আগুনের ভেতরে, মাটির নীচে ঢুকলে তো সব শান্ত, সব ঠান্ডা। পত্রিকা শুরু হয়েছে বুদ্ধদেব বসু’র প্রবন্ধ ‘হরি বোল’ দিয়ে। যত পাতা এগোয়, ততই মৃতরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাফেরা করে। শুভেন্দু দেবনাথ, শুভদীপ মৈত্র, অভিষেক চক্রবর্তী, সেলিম মণ্ডল, সোমব্রত সরকার, মৌলীনাথ বিশ্বাস এবং আরও অনেকের কলমে উঠে এসেছে নিজেদের শ্মশানের কথা। শ্মশানের ‘ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট’ কীভাবে হয়, সেটা নিয়ে একটি স্টার্ট আপের কর্ণধার শ্রুতি রেড্ডির সাক্ষাৎকারও রয়েছে এই সংখ্যায়।

আমাদের লেখা

তথাকথিত কবিতা যাপন বা অক্ষর-শব্দ নিয়ে ঘর সংসার করা হয়তো নয়। কিন্তু এমন অনেকেই আছেন, যাঁদের টেবিলের কোণের ছোট্ট ডায়েরিটা সুযোগ পেলেই ভরে ওঠে কবিতায়, গল্পে। তাঁরাও বলতে পারেন, এসব হল ‘আমাদের লেখা’। সম্পাদক রাজকুমার ঘোষের ‘আমাদের লেখা’ পত্রিকায় যুক্ত হয়েছে সেই লেখাগুলোই।

পত্রিকা গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’র স্রষ্টা ষষ্টীপদ চট্টোপাধ্যায়। পত্রিকার শুরুতেই রয়েছে মৌ দাশগুপ্ত’র কলমে ‘নবদুর্গা’ নিয়ে ভিন্নস্বাদের একটি লেখা। দুর্গার নয়টি রূপকে অন্যভাবে উপস্থাপিত করেছেন তিনি। ছড়া ও কবিতা তো বটেই, এখানে স্থান পেয়েছে অণুগল্পও। সুজান মিঠি, সহেলী রায়, পূর্বা মুখোপাধ্যায়, পিনাকী বসু, নির্মলেন্দু কুণ্ডু প্রমুখের অণুগল্পের সঙ্গে আছে আর্যতীর্থ, দীপক আঢ্য, অংশুমান চক্রবর্তী ও আরও অনেকের কবিতাও।  

লুপ্তাক্ষর

বিলম্বিত হলেও, এই পত্রিকার প্রকাশ স্বাভাবিক। একদম শুরুতেই বলে দেওয়া- ‘পড়বার, পড়ে শোনাবার, বুঝে দেখবার সাহিত্যপত্র’। প্রচ্ছদের আলো-ছায়ার মতোই ভেতরেও রয়েছে সেই রহস্যের অনন্ত হাতছানি। পাঠক নিজেই উপলব্ধি করবেন সেই দীপ্তি। সম্পাদক নিজেও গোপনে তাঁকে বলে দিচ্ছেন সেই কথা- “পৃথিবীতে আলো খুব/ অন্ধকার গাঢ় আজ অনন্তের দিকে/ আলোর প্রদীপ নিয়ে পাড়ি দিতে হবে বহুদূর”…

লিটল ম্যাগাজিন জগতের একটি পরিচিত নাম ‘লুপ্তাক্ষর’। কবি মিলন চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় এই পত্রিকা তরুণ লেখকদের অন্যতম মঞ্চ। মূলত দুটি বিভাগ – ‘কবিতা’ এবং ‘ঘষা কাচের আড়াল থেকে’। দ্বিতীয়টি গদ্য বিভাগ। ঘষা কাচের ওপার থেকে পাঠকদের মনে আলো ফেলে বিভিন্ন বিষয়। সত্তরের দশক, বিপ্লব, লিটল ম্যাগাজিন এবং কৃষ্ণনগর— এই চারটি বিষয় জুড়ে আছে শ্যাম বিশ্বাসের লেখায়। বাংলায় একসময় প্রচলিত বিভিন্ন মিক্সচার এবং ওষুধ, যা কালের নিয়মে আজ হারিয়েই গেছে, সেসবই উঠে এল আরেক ডাক্তার ও লেখক অরুণাচল দত্ত চৌধুরীর লেখায়। কথায় কথায় এসে পড়েছে ‘মহাত্মা অ্যান্ড কোং’-এর কথাও। যেখান থেকে জীবনের শেষ দিনগুলোয় ওষুধ যেত জোড়াসাঁকোয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে।

কবি গোবিন্দ চক্রবর্তীর স্মৃতিচারণা উঠে এসেছে তাঁর মেয়ে বাসবী চক্রবর্তীর কলমে। বাংলার পাঠকেরা এই নামটি হয়তো এখন মনে করতে পারবেন না। প্রায় স্মৃতির আড়ালেই চলে গেছেন। কিন্তু রানাঘাটের মানুষদের কাছে তিনি সেখানকার এক কৃতী সন্তান। বাবার কথা, তাঁর কবিতার কথাই বলেছেন বাসবী চক্রবর্তী।

‘লুপ্তাক্ষর’-এর কবিতায় রয়েছেন সমরজিৎ সিংহ, সেলিম মণ্ডল, পীযুষকান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়, সেখ সাদ্দাম হোসেন, অভিষেক মুখোপাধ্যায়-সহ এই সময়ের অন্যান্য কবিরা। পত্রিকার শেষে, প্রয়াত কবি পিনাকী ঠাকুরকে স্মরণ করেছেন সম্পাদক মিলন চট্টোপাধ্যায়। কবিতা ছাড়া, শব্দ ছাড়া আর কি কিছু শ্রেষ্ঠ উপায় আছে এই মানুষদের স্মরণ করার?          

রাত্রি সব জানে

মফস্বল—শব্দটি শুনলেই অনেকে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। পড়ারই কথা হয়তো। এর হাত ধরেই তো তাদের বেড়ে ওঠা, ভালবাসা, স্নেহ। সব জড়িয়ে আছে এই চার অক্ষরের শব্দের মধ্যে। ইঁদুরদৌড়ের বর্তমানে দাঁড়িয়ে সেই মফস্বলকে কি ফিরে পেতে ইচ্ছা করে না? ‘রাত্রি সব জানে’-এর সাম্প্রতিক সংখ্যায় সেই মফস্বলকে নিয়ে লিখেছেন সুলিপ্ত মণ্ডল ও শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। আসলে সবাই তো নিজেদের ভেতর একটা মফস্বল পুষে রাখে…

“ছোটবেলা থেকেই দেখছি আমার মা কপালে বড় টিপ পরে। মায়ের কাছে শুনেছি, আমিই নাকি খুব জোর করতাম মাকে বড় টিপ পরতে…”— এমনটা কি বাকিদের শৈশবের কথাও নয়? এইরকম ছোটো ছোটো চিলেকোঠার বন্ধুত্ব দিয়ে সাজানো এই সংখ্যা। মহর্ষি দত্ত’র সম্পাদনায় এই পত্রিকায় অন্যান্য বিভাগের সঙ্গেই রয়েছে কবিতাও। সুমন জানা, শুভদীপ চক্রবর্তী, গৌরাঙ্গ শ্রীবাল, পৃথ্বীরাজ বসু ঠাকুর প্রমুখের কবিতার স্বাদ পাবেন পাঠকরা। প্রচ্ছদটি করেছেন সুলিপ্ত মণ্ডল।

সপ্তপর্ণ

কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘এক দশকে সংঘ ভেঙে যায়’। কিন্তু সব কথারই বোধহয় কিছু কিছু ব্যাতিক্রম থাকে। ‘সপ্তপর্ণ’ পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যা একটি বিশেষ সংখ্যা। দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই সংখ্যায় সম্পাদক শমীক জয় সেনগুপ্ত কোনো সূচিপত্র রাখেননি। প্রতিটা পাতায় ঢুকে পাঠকই খুঁজে নিক তার পছন্দের লেখা, এটাই চেয়েছেন তিনি।

ব্লগজিন থেকে মুদ্রিত সংখ্যায় আসার এই যাত্রায় খানিক পেছন ফিরে দেখা দিনগুলো। ‘সপ্তপর্ণ’-এর বিশেষ সংখ্যায় সেই দিনগুলির কথাই উঠে এসেছে শমীক জয় সেনগুপ্ত, বৈজয়ন্ত রাহা, মৌ দাশগুপ্তের লেখায়। এছাড়াও রয়েছে সুবোধ সরকারের একটি সাক্ষাৎকার। একসময় এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কবি পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত। ২০১৭ সালে তাঁকে হারায় বাংলা সাহিত্য। তাঁরই অপ্রকাশিত একটি কবিতা দিয়ে সপ্তপর্ণের কবিতা বিভাগ শুরু হয়েছে। কৃষ্ণা বসু, সুধীর দত্ত, ঋজুরেখ চক্রবর্তী, পার্থজিৎ চন্দ, জগন্নাথদেব মণ্ডল-সহ আরও অনেকের কবিতায় সমৃদ্ধ এই সংখ্যা। রয়েছে বেশ কিছু ছোটগল্প ও অনুবাদ।

বোধশব্দ

কবিতার সঙ্গে লিটল ম্যাগাজিনের সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে কিছু আর বলার নেই। তবে যে-বিষয়টি অনুচ্চারিত হয়েও অঙ্গাঙ্গী জড়িত, তা হল গল্প। হ্যাঁ, লিটল ম্যাগাজিন বাংলার তরতাজা গল্পেরও আঁতুড়ঘর। কবির তুলনায় সংখ্যাটা অনেক কম হলেও, গল্পকাররাও আপন করে নেন লিটল ম্যাগাজিনকে। এমনকি, বেশ কিছু পত্রিকার ‘বিশেষ গল্প সংখ্যা’ও প্রকাশিত হতে দেখা যায়। তেমনই একটি পত্রিকা বোধশব্দ’। সুস্নাত চৌধুরীর সম্পাদনায় বোধশব্দের ‘গল্প সংখ্যা’য় লিখেছেন পাঁচজন ‘না-গল্পকার’।

‘না-গল্পকার’ শব্দবন্ধটি অবশ্য সম্পাদকের ব্যবহার নয়। গল্পকারদের সম্পর্কে সম্পাদক জানিয়েছিলেন, “এই সময়েরই তাঁরা, কিন্তু গল্প আগে লেখেননি, বা কদাচিৎ লিখলেও তা পঠিত নয় – এমনই পাঁচ ‘বেখাপ্পা’ লেখকের গল্প উঠে এসেছে এই সংখ্যায়।” এই পাঁচজনের কেউ কবি, কেউ অধ্যাপক, কেউ গ্রাফিক ডিজাইনার, কেউ আবার চিকিৎসক। গল্প রচনা তাঁদের সহজাত কাজ নয়। তবু, তাঁরা গল্প লিখেছেন। সম্পাদকের কাছে যা ‘বেখাপ্পা’। আমাদের কাছে, তা বেখাপ্পা হয়েও সুন্দর। ব্যাতিক্রমী।

রাণা রায়চৌধুরী, বরুণ চট্টোপাধ্যায়, তৃণাঙ্কুর বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈকত দে আর মৈনাক পাল – এই পাঁচজনের তিনটি করে গল্প দিয়ে সেজে উঠেছে বোধশব্দের সেই সংখ্যা। প্রসঙ্গত, তৃণাঙ্কুর বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৌত্র।

বোধশব্দ চেনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ‘অর্ধেক প্রচ্ছদ’ রয়েছে এই সংখ্যাতেও। সম্পাদকের মতে, একসময় প্রচ্ছদ ছাপানোর খরচ বাঁচাতে শুরু করেছিলেন অর্ধেক প্রচ্ছদ। এখন সেই ‘স্টাইল’ ছাড়া ভাবাই যায় না পত্রিকাটিকে। তবে সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ বোধহয় পত্রিকার গল্পগুলিই। ভিন্নরকম গল্পের খোঁজ চাইলে, এই পত্রিকাটি হতেই পারে পাঠকের পরবর্তী লক্ষ্য।