মিম-সংস্কৃতির হাত ধরে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে বাংলা সাহিত্যও?

লকডাউনের দিনগুলো এনেছিল একরাশ নিঃসঙ্গ ফাঁকা সময়। যেখানে কোনো বন্ধু-বান্ধব নেই, বিকেলের আড্ডা নেই, খেলা-ধুলো নেই, নেই দল বেঁধে কোথাও ঘুরতে বেরিয়ে পড়ার সুযোগ। অনন্ত এই বন্দিজীবন কাটাতে কেউ কেউ শরণাপন্ন হয়েছিলেন বইয়ের কাছে। কেউ আবার মজে ছিলেন অনলাইন সিনেমা, সিরিজের মধ্যে। কিন্তু শুধু পড়লে বা দেখলেই সময় কেটে যায় না। অন্য কারোর সঙ্গে তা ভাগ করে নেওয়ারও একটা খিদে থেকেই যায় সব সময়। এই যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতাই তাই বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ার গুরুত্ব। যা ভাবনাচিন্তার আদান-প্রদানের মূল মাধ্যম হয়ে উঠেছিল আট থেকে আশি সকলের কাছেই। জন্ম দিয়েছিল বেশ কিছু গ্রুপ কিংবা পেজের। গড়ে উঠেছিল আলোচনার মাধ্যমেই ইতিবাচক দিক কিংবা সাহিত্যচর্চার বিকল্প প্ল্যাটফর্ম।

লকডাউনে জন্ম নেওয়া এমনই একটি গ্রুপ ‘আ গ্রুপ হয়্যার উই লিভ ইন বাংলা সাহিত্য মাল্টিভার্স’। কিন্তু কী ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য? কীই বা বিশেষত্ব এই গ্রুপের? কোনো সাধারণ ভাবে সাহিত্যচর্চা বলে যা বুঝি, ঠিক তা নয়। সাহিত্যকে অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মজার ছলে উপস্থাপনা করাই এই গ্রুপের প্রথম লক্ষ্য ছিল। গল্পের চরিত্রদের প্রাণোচ্ছল করে, হাসির আঙ্গিকে প্রতিস্থাপন করা। যাদের বই পড়তে বিশেষ ভালো লাগে না, তাদের কাছেও বাংলা গল্প-কবিতাকে পৌঁছে দেওয়া। আর সেই হাতিয়ারটাই হয়ে দাঁড়ায় অত্যন্ত পরিচিত মিম কালচার।

“এই গ্রুপটাকে ‘Pun-চালি’ গ্রুপেরই একটা ভাগ বলতে পারেন। ২০১৮ সালে শুরু হয়েছিল ওই গ্রুপটা। বাংলা ভাষা নিয়ে জাগলিং এবং বিভিন্নভাবে শব্দের সজ্জার মধ্য দিয়ে অন্যরকম একটা হিউমার তৈরি করাই উদ্দেশ্য ছিল। তবে পান সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বোধগম্য না হলে অনেকেই সেটা এড়িয়ে যান। সেখান থেকে সরে এসে শুধুমাত্র সাহিত্যকে ফোকাস করা হবে। সে জন্যই এই গ্রুপটা তৈরি করা আলাদাভাবে।” বলছিলেন গ্রুপের অ্যাডমিন অরবিন্দ মূলে। বর্তমানে হায়দ্রাবাদে রসায়ন নিয়ে গবেষণারত তিনি। অরবিন্দ বাবু জানান, বাংলা সাহিত্যের প্রতি আলাদা আকর্ষণ থেকেই তাঁদের এই উদ্যোগ। তবে সাহিত্যের সেই ক্যারিশমাটাকেই মিমের মাধ্যমে সকলের কাছে তুলে ধরার লক্ষ্য নিয়েই নেমেছেন তাঁরা।

বর্তমান তরুণ প্রজন্মের শিকড় বাংলা সাহিত্য থেকে আলগা হয়ে গেছে অনেকটা। এমনই একটা কথা হামেশাই শোনা যায় আশেপাশে। আংশিক হলেও সত্যি এই কথা। যদিও আজ থেকে দশ বছর আগে ১০০ শতাংশ মানুষই বই বলতে পাগল ছিলেন, এমনটা হয়তো না। অরবিন্দবাবু গল্পের ছলেই বলছিলেন লকডাউনে দু’জন ছাত্রকে তাঁর পড়ানোর অভিজ্ঞতা। “কথা বলতে বলতে ওদের থেকে জানলাম ওরা ‘আম আঁটির ভেঁপু’, ‘আরণ্যক’-এর নাম শোনেনি। তবে ‘পথের পাঁচালি’ বলে কোনো লেখা আছে, সেটার একটা অস্পষ্ট ধারণা রয়েছে। সে পড়েনি বলে তাকে ডিসকারেজ না করে, এমনভাবে সেটাকে রিপ্রেসেন্ট করতে হবে যাতে সে মজা থেকেই সেটা পড়ে দেখে।”

অরবিন্দবাবুর দেওয়া এই গ্রুপের পরিসংখ্যান থেকেও তা খানিকটা প্রতিফলিত হয়। গ্রুপের মাত্র ৩০ শতাংশ দর্শক ২৪ বছরের কম বয়সী। তবে তাঁদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন যাঁরা এই মিমগুলোর মজায় অংশগ্রহণ করলেও হয়তো সেই লেখা পড়ে দেখেননি। তবে মিম দেখার পর খুঁজেছেন সেই গল্প বা উপন্যাসটিকে। লকডাউনে তাই তাঁদের জন্য ক্লাসিক সাহিত্যের (কপিরাইট-ফ্রি) একটি ভার্চুয়াল লাইব্রেরি তৈরি করে ফেলেছেন তিনি।

তবে অন্যান্য মিমগুলির মতো এই পেজের মিমগুলি কখনোই আক্রমণাত্মক হয় না। প্রচ্ছন্নভাবে রাজনৈতিক মতবাদ মিমের অংশ হয়ে মাঝে মাঝে অবশ্যই, তবে তা রুচিশীল রাখার দায়িত্ব শক্ত হাতেই পালন করেন অ্যাডমিনরা। বাংলা সাহিত্য কেন্দ্রিক এই মিম-গ্রুপ যাতে খেউরের আখড়া না হয়ে ওঠে, তাতে নজর রাখেন তাঁরা। তবে যেকোনো লেখারই পছন্দ-অপছন্দ থাকে। তেমনই মাঝেমাঝেই পছন্দের লেখকদের লেখার ধাঁচ নিয়ে জমে ওঠে তর্ক-পাল্টা তর্ক। সেখান থেকেই উঠে আসে গঠনমূলক আলোচনাও। যা পারতপক্ষে বাকিদের মধ্যেও আলাদা উদ্যম জোগায় সেই লেখকের লেখা পড়ে দেখার।

কিন্তু মিমের মধ্যে দিয়ে সাহিত্যের উপস্থাপনায় কিছু মানুষ মনে করেন, তাতে সাহিত্যের কৌলীন্যহানি হয়। তবে অরবিন্দ মূলে যুক্তি দিয়েই ফুটিয়ে তুললেন তাঁর বক্তব্য। জানালেন, “সাহিত্যের কৌলীন্যহানি করা যায় বলে আমার মনে হয় না। রবীন্দ্রনাথ বলে গেছিলেন, ‘রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি’। এই সংকীর্ণতাটা রয়েই গেছে মানুষের মধ্যে। কেউ যদি বিরোধিতা করে তবে যুক্তি দিয়ে করুক। মিম দিয়ে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম কিংবা শরৎচন্দ্রের গল্পকে বোঝালে তাঁদেরকে ছোটো করা হয় না। মিম একটা দর্শনভঙ্গি। জানলা দিয়ে দেখি বা দরজা দিয়েই দেখি— এখানে দেখাটাই সবথেকে শেষ কথা। তবে হ্যাঁ অনেক অসম্মানজনক মিমকে অবশ্যই ফিলটার করা হয়।” 

সম্পূর্ণ বাংলা সাহিত্যকে নিয়ে না হলেও টিনটিন, নন্টে-ফন্টের কমিক্সও বাংলার মিম-কালচারে ঢুকে পড়েছে এমনই কিছু তারুণ্যের হাত ধরে। তৈরি হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায় মিম-পেজ। নিজেদের দায়িত্বেই, পুরো উদ্যোমে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন সেইসব পেজের অ্যাডমিনরা। তবে এই গ্রুপের অভিনবত্ব হল এখানে শুধু মিম বা কন্টেন্ট তৈরি করার দায়িত্ব অ্যাডমিনদের ওপর বর্তায় না। বরং গ্রুপের সমস্ত সদস্যরাই সেই দায়ভার কাঁধে নিয়ে নিয়েছেন। সকলেই একসঙ্গে নিজের নিজের পছন্দের গল্পের প্রাসঙ্গিকতা তুলে আনছেন প্রচলিত মিম টেমপ্লেটের মধ্যে দিয়ে। কোথাও যেন নিজেদের লড়াইয়ের ব্যাটনটাই অ্যাডমিনরা তুলে দিচ্ছেন সকল দর্শকদের হাতেও।

অরবিন্দ মূলে বলছিলেন, “কারো হয়তো বুদ্ধদেব ভালোলাগে। কারোর হয়তো শীর্ষেন্দু, স্মরণজিৎ। কেউ আবার শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথেই মজে থাকেন। এই গ্রুপটা বানানো হয়েছিল সেইসব লেখকদের লেখা চরিত্রযাপনের জন্য। যেখানে আপনি ‘বলাই’ হতে পারেন, কিংবা বলাইয়ের বন্ধু। বিভিন্ন চরিত্রদের মধ্যে নিজেদের খুঁজে পাওয়ার চেষ্টাই করছেন এখানে সকলে।”

তাই তো কখনও সত্যজিৎ রায়ের ‘ব্রেজিলের কালো বাঘ’-এর প্রচ্ছদে বসে যায় ব্ল্যাক প্যান্থারের ছবি। কখনো আকাশে উড়তে থাকা শঙ্খচিল, শালিক দেখে অবস্থান জিজ্ঞেস করা খ্রিস হেমসওয়ার্থকে জীবনানন্দ বলে দেন ‘ধানসিঁড়িটির তীরে’। এভাবেই সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে এক অভিনব যাপনকের উৎসব চলছে এই গ্রুপে। দুঃসময়কে পাল্লা দিয়েই রমরমিয়ে চলছে আনন্দ ভাগ-বাটোয়ারা করে নেওয়ার উল্লাস। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, লকডাউনের পরে, এই মহামারী পেরিয়ে যাওয়ার পরে এই অভিনব উদ্যোগ কি বন্ধ হয়ে যাবে তবে? 

তার উপায়ও অবশ্য ভেবে রেখেছেন অ্যাডমিনরা। সেইসময় রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, জীবনানন্দকে নিয়ে বিভিন্ন ইভেন্ট চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। দরকার হলে কপিরাইট ছাড়া কিছু বইয়ের পিডিএফ-ও তার জন্য গ্রুপে দিতে রাজি তাঁরা। অন্তত সাহিত্যের সঙ্গে যেন জুড়ে থাকে মানুষ। বই যেমন আমাদের সঙ্গ দেয় কম-বেশি, তেমনই বইকেও সঙ্গী জুটিয়ে দেওয়ারই যেন কর্মযজ্ঞ নিয়েছে এই গ্রুপ। সেখানে মিমের সঙ্গে গা ঘেঁষা-ঘেঁষি করেই দিন কেটে যাচ্ছে ব্যক্তি আর বইয়ের...

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More