মদের দোকান খুলতেই ‘ভঙ্গুর’ লকডাউন – আদৌ কি প্রয়োজন ছিল এর?

লকডাউনে কাজ-টাজ সামলে বেশ নিশ্চিন্তে বসে আছেন। হঠাৎ শুনলেন, বাইরে কীসের যেন গোলমাল। কী ব্যাপার? এখন তো করোনার ভয়ে সবাই ঘরের ভেতর। লকডাউনে এমনিতেই সব থমথমে। এই চিৎকার কোথা থেকে এল? বারান্দা থেকে ভালো বোঝা যাচ্ছে না দেখে ছাদে গেলেন। লকডাউনে এত মানুষ রাস্তায় কী করছে? পুলিশ কোথায়? তাহলে কী রেশন দেওয়া হচ্ছে? একপ্রকার ‘রেশন’ই বলতে পারেন। পাড়ার সবচেয়ে বড়ো মদের দোকান থেকে শুরু হয়েছে এই লাইন। রাস্তা পেরিয়ে কোথায় যে শেষ হয়েছে, দেখাই যাচ্ছে না!

এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, ভারতের নানা জায়গাতেই এমন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ ক্যামেরাবন্দি করছেন, সোশ্যাল মিডিয়ায়ও ‘ভাইরাল ফিভার’। সবকিছুর মূলে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সিদ্ধান্ত— দেশের প্রায় সর্বত্র মদের দোকান খোলা হবে। কেবল রেড জোনগুলোতে একটু নিয়মের কড়াকড়ি থাকবে। আর যে সব জায়গায় অতিমাত্রায় করোনা ছড়িয়েছে, সেখানে না খোলারই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর একটি কারণও বলা হয়েছে। যেহেতু আবগারি দফতর থেকে রাজ্য এবং দেশের প্রশাসন ভালো পরিমাণে শুল্ক আয় করে, তাই কোষাগার ভরার একটা দিক অন্তত খুলে রাখার পদক্ষেপ নেওয়া হল।

দেশের যে সমস্ত জায়গায় রেড জোন (যেমন- কলকাতা, জয়পুর, দিল্লি, মুম্বই, হায়দ্রাবাদ ইত্যাদি) ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে মার্কেট এরিয়া বাদ দিয়ে অন্যত্র লিকার শপ বা মদের দোকান খোলার কথা বলা হয়েছে। এটাই আপাতত কেন্দ্রের প্রাথমিক ঘোষণা। তবে আরও কিছু শর্ত, নিয়মের তালিকা প্রকাশ হতে পারে বলে জানা যাচ্ছে। যেহেতু করোনার জেরে পরিস্থিতি এমনিতেই টালমাটাল, তাই বিস্তর বৈঠক ও ভাবনাচিন্তা করা হচ্ছে। অবশ্যই এর মধ্যে পড়ছে সোশ্যাল ডিসটেনসিং। একসঙ্গে অনেক লোক যাতে জড়ো না হন, সেই কথাই বলা হচ্ছে বারবার।

এ তো গেল নিয়ম-নীতির কথা। কেন সরকার এটা করল, তারও একটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। কিন্তু বাস্তবে কী দেখা যাচ্ছে? কোভিড-১৯ বলে কোনো রোগের অস্তিত্ব আছে, সেটাই অনেকের মাথা থেকে উধাও হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে দেশে আক্রান্তের সংখ্যা পেরিয়েছে ৩০ হাজার, স্মরণে নেই সেই কথাও। মদের দোকান খুলতে না খুলতেই লম্বা লাইন! লোকজন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে; সোশ্যাল ডিসটেনসিং! সে তো অন্য গ্রহের কথা। অনেকে তো রাত থাকতেই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছেন। এতদিন ঘরে বন্ধ, স্টকে যা ছিল সব শেষ হয়ে গেছে আগেই। কাজেই না পেরে নিজের ‘রসনার নেশা’কে তৃপ্তি দেওয়ার জন্য মদের দোকানগুলোতে ভিড় জমাচ্ছেন মানুষরা।

দিল্লির মতো কিছু জায়গায় বাধ্য হয়ে লাঠিও চালাতে হয়েছে পুলিশকে। কিছু তো করারও নেই, তাঁরাও অপারগ। অনেক জায়গায় বিশেষ নিয়মও জারি করেছে প্রশাসন। পশ্চিমবঙ্গেও রেড জোনগুলোতে দুপুর ১২টা থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত মদের দোকান খোলা থাকবে। বাকি জায়গায় খোলার সময়টা শুধু সকাল ১০টা করা হয়েছে। এবং অবশ্যই সমস্ত কিনে সরাসরি নিজের বাড়িতে গিয়ে সমস্ত আয়োজন করার কথা বলা হয়েছে। সবই তো ঠিক আছে, কিন্তু গোটা সোমবার জুড়ে যা দেখে এসেছি আমরা, সেটা কি সচেতনতার বিন্দুমাত্র প্রমাণও দিচ্ছে? আমরা নিজেরাই কি দোষী নই? যেখানে যে কোনো প্রকারের সামাজিক জমায়েতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেখানে এমনটা করা হল কেন? প্রশাসনকে প্রশ্ন করার আগে নিজেদেরকে প্রশ্ন করা উচিত। এরপরও একই ছবি দেখব, একইভাবে ভাইরাল হবে সব। অথচ সচেতনতা ভাইরাল হবে না। মদের নেশার কাছেই হার মানবে সব…
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

More From Author See More