জন্ম দিয়েছিলেন নতুন সঙ্গীত জঁরের, প্রয়াত কিংবদন্তি টোস্টার ইউ-রয়

১৯৭০ সাল। জামাইকার এক বারে গিয়েছেন প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী জন হল্ট। ফ্লোর জুড়ে নাচছে অসংখ্য যুবক-যুবতী। নেশা লাগানো ডিউক রেইডের গান চলছে ডিজে-তে। এমন সময়ই হঠাৎ গেয়ে উঠল একটি কণ্ঠস্বর। না, ঠিক গান বলা যায় না এই শৈলীকে। বাজনার তালে তালে বলে যাওয়া হচ্ছে কিছু কথা। মানুষের দৈনিক যাপনের গল্প। আর তা যেন ম্যাজিক্যাল করে তুলছে গোটা বিষয়টিকে। মুগ্ধ হয়ে অনুষ্ঠান শেষের পর হল্ট নিজে আলাপ করলেন সেই যুবকের সঙ্গে। নাম ইউ-রয়। ঠিক হল হল্ট নিজে কথা বলবেন ডিউকের সঙ্গে। আর তিনি রাজি থাকলে তাঁর এবং রেইডের যুগলবন্দিতে কণ্ঠ দেবেন ইউ-রয়।

জামাইকার রেজি সঙ্গীতের জঁর এবং টোস্টিং-এর ইতিহাসে পথিকৃৎ ছিলেন রয়। ষাট দশকের গোড়ার দিকে তিনিই জন্ম দিয়েছিলেন এই অভিনব সঙ্গীতশৈলীর। যে ভোকাল স্টাইল জনপ্রিয়তায় প্রায় সবকিছুকেই ছাপিয়ে যায় জামাইকাতে। তবে ছন্দপতন হল সেই সাবলীল তালে। বিদায় নিলেন কিংবদন্তি রেজি শিল্পী ইউ-রয়। 

বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন তিনি। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনির গুরুতর সমস্যায় ভুগছিলেন রয়। গত কয়েক সপ্তাহে প্রায় রুটিন ভিজিট করতে হয়েছে হাসপাতালে। হয়েছিল অস্ত্রোপচারও। তবে দ্বিতীয়বার অপারেশনের যন্ত্রণা আর নিতে পারলেন না। হচ্ছিল অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ। চিকিৎসকদের অনেক চেষ্টার পরও বুধবার গভীর রাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ‘টোস্টিংয়ের জনক’।

জামাইকার রাজধানী কিংস্টোনের জোনস টাউনে রয়ের জন্ম ১৯৪২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। সরকারি পরিচয়পত্রে নাম এভার্ট বেকফোর্ড। পরবর্তীকালে মঞ্চ প্রদর্শনী এবং অ্যালবামের জন্য ‘ইউ-রয়’ পোশাকি নাম নেন এভার্ট। ছোটথেকেই সঙ্গীতের পরিবেশের মধ্যে বড়ো হয়েছেন এবার্ট। মা ছিলেন নিকটবর্তী একটি চার্চের কয়ার-গায়িকা। তবে এই ধরণের ধর্মীয় সঙ্গীত খুব একটা পছন্দ ছিল না এভার্টের। বরং কিশোর বয়স থেকেই জেমস ব্রাউন, রুথ ব্রাউন, মাইলি লিউয়িস, লুইস প্রাইমা শুনতে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি।

রয় সেই বয়সেই এক রকমের ঠিকই করে নিয়েছিলেন সঙ্গীত নিয়েই বাঁচতে হবে তাঁকে। তবে বাধ সাধল অন্য একটি জায়গায়। তা হল উচ্চারণে। স্ট্যামারিং থাকার কারণে লয়, তাল মেনে একটানা গাইতে পারতেন না এভার্ট। মাঝে মাঝেই থমকে যেত কথা। ১৯৬১ সালে গায়ক হওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে পেশাগতভাবে বেছে নেন ডিজে-কে। 

শুরুতে স্যর কক্সসন ডড, কিং সিটের বেশ কয়েকটি সাউন্ডট্র্যাকে কাজ করেছেন রয়। সেইসঙ্গে তৎকালীন জামাইকার বিভিন্ন পান্থশালায় একচেটিয়া অনুষ্ঠান করতেন তিনি। এমনই বিভিন্ন মঞ্চ প্রদর্শনী করার সময়ই তিনি জন্ম দেন টোস্টিংয়ের। গানের সঙ্গে মিশিয়ে দেন গল্পকে। ‘ফ্রি কেবল’-এর এক সাক্ষাৎকারে বছর কয়েক আগে হেঁসেই জানিয়েছিলেন, ‘ঠিক কীভাবে শুরুটা হয়েছিল মনে নেই আর’।

আরও পড়ুন
সঙ্গীতের ‘অণুপ্রেরণা’য় কাকা, তাঁর কঙ্কাল দিয়েই গিটার বানালেন মার্কিন যুবক!

সত্তর দশকের দিকে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা পায় টোস্টিং। শুধু জামাইকাই নয়, বরং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের বিনোদনের অন্যতম অঙ্গ হয়ে উঠেছিল টোস্টিং এবং রেজি। ১৯৭৬ সালে প্রকাশ পায় তাঁর দুটি একক অ্যালবাম— ‘ড্রেড ইন দ্য ব্যবিলন’ এবং ‘ন্যাটি রেবেল’। ৮০-র দশকে আক্ষরিক অর্থেই শ্রোতাদের জোয়ারে ভাসিয়েছিল তাঁর ‘দ্য টাইড ইজ হাই’। ২০০৪ সালে ‘টুথ অ্যান্ড দ্যা মেটাল’ দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ‘ট্রু লাভ’ অ্যালবামটির কাজ করেন রয়। এই অ্যালবামের জন্য তিনি স্বাদ পেয়েছিলেন গ্র্যামিরও। ২০০৭ সালে জামাইকা সরকার থেকে তাঁকে প্রদান করা হয় ‘অর্ডার অফ ডিসটিংকশন’ সম্মাননা।

তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন গ্র্যামি-জয়ী সঙ্গীতকার শ্যাগি এবং ঘোস্টপোয়েট। শেষ হল রেজি সঙ্গীতের এক দীর্ঘ অধ্যায়। চোখ বুজলেন সারাজীবন সাধারণের গল্প বলা আসা মানুষটা। এবার যে তাঁর বিশ্রামের সময়। বাঁচার সময় কিংবদন্তি গল্পদের বুকে…

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
সর্বোচ্চ সংখ্যক গ্র্যামির অধিকারী তিনি, প্রয়াত কিংবদন্তি জ্যাজ সঙ্গীতশিল্পী চিক কোরিয়া