‘আমরা বিভাজন চাই না’– দলীয় পতাকার বাইরে এসে ফের নিজেকে চিনিয়ে দিল কলকাতা

ডিসেম্বরের শীত পড়ছে একটু একটু করে। বৃহস্পতিবারের কলকাতা আড়মোড়া ভেঙে ব্যস্ত হচ্ছে। কিন্তু রোজ যেরকমটা কাটে, এই দিনটা যেন অনেকটাই আলাদা। শহরের একটা অংশে ভিড় বাড়ছে। দলে দলে মানুষ ছুটে যাচ্ছেন মৌলালির রামলীলা ময়দানে। বৃদ্ধের কাঁপা গলায় শোনা যাচ্ছে— “আমার প্রতিবাদের ভাষা/ আমার প্রতিরোধের আগুন”। তাঁকে, এবং তাঁর মতো আরও অনেককে ঘিরে ছড়িয়ে পড়ছে পুরো ভিড়টা। সবার ভাষা একটাই, “সংবিধান বাঁচাও। ধর্ম নিয়ে খেলা আর নয়। এনআরসি নয়।”

আরও পড়ুন
সরব হয়েছেন অসমের বাঙালি-বিদ্বেষ বা ধর্মীয় বিভাজন নিয়েও, আজকের ভারত দেখলে কী বলতেন কালিকাপ্রসাদ?

হোক কলরবের পর এমন স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন কলকাতার মানুষ আর দেখেননি। সাম্প্রতিক সময় পাশ হওয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং এনআরসি নিয়ে দেশ জুড়ে চলছে প্রতিবাদ। ভারতের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছেন। মারাও গেছেন কয়েকজন। তারই অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার, ১৯ তারিখ কলকাতা দেখল এক মহামিছিল। না, কোনও রাজনৈতিক ব্যানার বা পতাকার নীচে এটি হয়নি। সাধারণ মানুষ, পড়ুয়া থেকে বিদ্বজ্জন— সবাই এক হয়ে পথে নেমেছিলেন। সঙ্গে ছিল জাতীয় পতাকা। আর মুখে শ্লোগান। মিছিল যখন পুরসভার লাল বাড়িটার কাছে পুলিশের ব্যারিকেডের সামনে এসে দাঁড়াল, তখন তার শেষ মাথা মৌলালির মোড়ও ছাড়ায়নি। সবার মুখে একটাই কথা, "আমরা বিভাজন চাই না।"

এস এন ব্যানার্জি রোড এবং ধর্মতলার মুখটা তখন মাথায় মাথায় ছয়লাপ। ব্যারিকেড টপকে যাওয়া হয়নি, তাই রাস্তাতেই বসে পড়ে সবাই। এক একটা জটলা থেকে উঠে আসে গান, শ্লোগান, কবিতা। দল বেঁধে তাঁরা প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সেখানে কোনও আগুন নেই, কোনও ভয় নেই, হুংকার নেই, ধ্বংসলীলা নেই। আগুন কি সত্যিই ছিল না? হেসে উঠল একটি ছেলে। হাতের গিটার অজান্তেই বেজে উঠল তাঁর। জানিয়ে দিল, আছে। সেই আগুনই এতগুলো মানুষকে একসঙ্গে বেঁধে রেখেছে।

এরই মধ্যে একটি অল্পবয়সি ছেলে সমস্ত জটলায় ঘুরতে লাগল। হাতে জলের বোতল। সবার কাছে গিয়ে জেনে নিচ্ছে কারোর তেষ্টা পেয়েছে কিনা। যার দরকার, তাঁকে সঙ্গে সঙ্গেই দিয়ে দিচ্ছে একটা বোতল। ছেলেটা এখনও জানে না, সে ভারতের নাগরিক কিনা। মিছিলের অনেকেই জানে না ‘নাগরিক’ হওয়ার সংজ্ঞা এখন ঠিক কী। কিন্তু তাঁরা তো হারতে জানে না। মুহূর্তে বেজে উঠছে দোতারা, গিটার, হ্যান্ড পারকাশন। গণতন্ত্র রক্ষা যে তাঁদের কর্তব্য, সেটাই তাঁরা বলে দিচ্ছে বারবার। ফুটপাত থেকে পথচলতি মানুষও সেই সুরে যোগ দিচ্ছে। কেউ বলে দেয়নি তাঁদের। নিজে থেকেই…

একটি মিছিল। যার শীর্ষে কোনও হাই প্রোফাইল রাজনীতিবিদ নেই। কোনও দলের পতাকা নেই। শুধু আছে জাতীয় পতাকা। আর আছে বিশ্বাস, গণতন্ত্রকে বাঁচানোর বিশ্বাস। যে মিছিলের একটি নিজস্ব শ্বাস আছে, নিজস্ব আগুন আছে। অজান্তেই তার থেকে তাপ নিয়ে চলে যাচ্ছি আমরা। যার কোনও মুখ নেই, আছে সংবিধানের প্রস্তাবনার পাতাটি। এমনই এক স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল দেখল পৌষের শহর। শাসকের বিরুদ্ধে, নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে ছড়িয়ে পড়ল আওয়াজ। হয়ত বাড়ি ফিরে হাতে উঠে আসবে গিটার। পরেরদিন আবার রাস্তায়, সঙ্গে বেজে উঠবে সেই অমোঘ মন্ত্র— “আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু।”

ছবি ঋণ - মোহিত তন্ময়

More From Author See More