২৫ কোটি টাকার প্রতারণা ও কেরলের 'অ্যান্টিক ডিলারে'র গল্প

যিশুর পোশাক থেকে শুরু করে টিপু সুলতানের সিংহাসন, নবী মহম্মদের ব্যবহৃত সামগ্রী কিংবা জুডাসের রৌপ্যমুদ্রা, লিওনার্দো ভিঞ্চির আঁকা ছবি— কেরলের কোচি শহরের মিউজিয়ামে গেলে দেখা মিলত এমনই সব বহুমূল্য ঐতিহাসিক সামগ্রীর। না, এই মিউজিয়াম সরকারের নয়। বরং, তা একজন ব্যক্তির। কথা হচ্ছে কেরলের অ্যান্টিক ডিলার মনসন মাভুঙ্কালকে (Monson Mavunkal) নিয়ে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর কয়েক কোটি টাকা প্রতারণার অভিযোগে তাঁর বাড়ি থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে কেরল ক্রাইম ব্রাঞ্চ। অবাক করার বিষয় হল, তাঁর শিকারের তালিকায় রয়েছেন রাজনীতিবিদ, পুলিশকর্তা, খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বরা। প্রশ্ন থেকে যায়, এমন সব প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের কীভাবে নিজের ফাঁদে জড়ালেন মাভুঙ্কাল?

বছর কয়েক আগের কথা। কেরলের আলাপুঝা জেলা থেকে কোচিতে এসে আস্তানা গাড়েন মাভুঙ্কাল। সেসময় তাঁর কোচি শহরের বাসস্থানটাও ছিল ভাড়া নেওয়া। কিছুদিনের মধ্যে সেই বাড়িকেই আস্ত জাদুঘরে রূপান্তরিত করেন তিনি। নিজের পরিচয় দিতেন অ্যান্টিক ডিলার হিসাবে। অবশ্য প্রাথমিকভাবে তাঁর কোচির এই বাড়ি থেকে কেনাবেচা চলত না। বরং, তিনি মিউজিয়ামের দরজা খুলে দিয়েছিলেন সাধারণের জন্য। তাঁর চোখ ধাঁধানো সংগ্রহ দেখতে রীতিমতো ভিড় লেগে থাকত দর্শকদেরও। সেখান থেকেই ক্রমশ প্রশাসনিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন মনসন। 

কিন্তু কোথা থেকে এল এইসব দুর্মূল্য সামগ্রী? সেই জায়গাতেই লুকিয়ে রয়েছে রহস্যের জাল। আসলে তাঁর এই বিপুল সংগ্রহের অধিকাংশ সামগ্রীর সত্যতাই প্রশ্নচিহ্নের সামনে। স্রেফ উপস্থাপনের মাধ্যমেই ভুয়ো প্রত্নসামগ্রীকে অনন্য করে তুলেছিলেন মনসন। উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিক কিংবা প্রশাসনিক নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা যেন আরও বাস্তব করে তুলেছিল তাঁর সংগ্রহকে। তাঁর ব্যক্তিগর ওয়েবসাইট এবং ইউটিউব চ্যানেলে তাঁকে হামেশাই দেখা যেত খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে। তাঁদের কারোর হাতে ধরা টিপু সুলতানের তরবারি, কেউ আবার বসে রয়েছেন মনসনের সংগ্রহে থাকা রাজারাজরাদের সিংহাসনে। 

এভাবেই ক্রমশ বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেন মনসন। এমনকি তাঁকে এবং তাঁর এই সংগ্রহের সুরক্ষার জন্য পৃথক ব্যবস্থাও নিয়েছিল কেরল পুলিশ। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতারণার ‘ব্যবসা’ শুরু তার পরে। যাঁদের সঙ্গে তাঁর ওঠা-বসা, কেরলের সেই প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বরাই প্রথম শিকার হন তাঁর। ধীরে ধীরে তাঁর ব্যবসার পরিধি ছড়িয়ে পড়ে ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও। লেনদেন চলত কোটি কোটি টাকার। উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিকদের থেকে ব্যবসার জন্য বড়ো অঙ্কের টাকা ধারও করেছিলেন মাভুঙ্কাল। পাশাপাশি সমাজসেবী এবং শান্তি-প্রবর্তকের ভাবমূর্তি ধরে রাখতে ইউটিউবে মোটিভেশনাল স্পিচ দেওয়াও শুরু করেন তিনি।

আরও পড়ুন
টাকা নিয়েও পাঠালেন ‘ফাঁকা ফ্রেম’, অভিনব প্রতিবাদ ড্যানিশ শিল্পীর

২০১৭ সালে প্রথম তাঁর ব্যবসার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কেরলেরই এক পুলিশ অধিকর্তা। তারপরই সামনে আসতে থাকে একের পর এক জালিয়াতির অভিযোগ। সেই বছরই তাঁর নামে ১০ কোটি টাকার প্রতারণার মামলা দায়ের করেন কেরলের ছয় ব্যক্তি। বর্তমানে যে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ২৫ কোটিতে। তৎকালীন সময়ে ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট আইনের আওতায় বন্ধ করা হয়েছিল তাঁর আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলি। তবে তারপরেও থামেনি তাঁর প্রতারণাচক্র।

আরও পড়ুন
অর্থ তছরুপ ও জালিয়াতিতে দোষী মহাত্মা গান্ধীর প্রপৌত্রী!

কিন্তু কীভাবে বিগত চার বছর ধরে ব্যবসা চালিয়ে গেলেন তিনি? গ্রেপ্তারই বা করা হল না কেন তাঁকে? কেরলের একাধিক সংবাদপত্রের দাবি, তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল প্রশাসনিক কর্তাদের। মধ্যবর্তী সময়ে নিজের ওয়েবসাইটেও তিনি দাবি করেছিলেন, বৈদেশিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফের চালু করা নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে কেরলের মুখ্যমন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও। সব মিলিয়ে তাঁর এই ভুয়ো ভাবমূর্তিই যেন হ্যালুসিনেশনে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল গোটা শাসন ব্যবস্থাকে।

আরও পড়ুন
জালিয়াতি রুখতে বদলে যাচ্ছে এটিএমে টাকা তোলার নিয়ম-কানুন, জেনে নিন

তবে শুধু যে অর্থজালিয়াতি কিংবা প্রতারণা, তা নয়। সম্প্রতি কোচির এক মহিলা তাঁর বিরুদ্ধে ব্ল্যাকমেলিং-এর অভিযোগ আনেন। মনসনের এক বন্ধুর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করায় তিনি ক্রমাগত গোপন ছবি ফাঁস করার হুমকি দিয়ে গেছেন বলেই অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। সব মিলিয়ে যেন অভিযোগের পাহাড় জমে আছে কেরলের এই অ্যান্টিক ডিলারের নামে। মনসন-গ্রেপ্তারের পরই বিশেষ তদন্ত কমিশন গঠন করেছে কেরল সরকার। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে তাঁর সংগ্রহের বিপুল ভাণ্ডার। সেগুলির সত্যতা নিয়েও পরীক্ষানিরীক্ষা চলবে বলে জানাচ্ছে কেরল পুলিশ। কিন্তু এত কিছুর পরেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, সরকারের নিষ্ক্রিয়তা নিয়েই…

Powered by Froala Editor