দেবদাসীদের জীবন সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তুলছেন দেবদাসী-কন্যা মঞ্জুলা

দেবদাসী প্রথা যেন ইতিহাসের এক বিভীষিকা। বছর পঞ্চাশ আগেও দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তা ছিল জ্বলন্ত বাস্তব। আজও কি কোথাও কোথাও থেকে গিয়েছে দেবদাসী (Devdasi) প্রথা? কর্ণাটকের সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্রী মঞ্জুলার (Manjula) গবেষণার বিষয় এই দেবদাসীরাই। তবে শুধু গবেষণার বিষয় বললে একটু ভুল হবে। মঞ্জুলা নিজেও উঠে এসেছেন সেই জীবন থেকেই। না, তিনি নিজে কোনোদিন মন্দিরে দেবদাসী জীবন কাটাননি। কিন্তু তাঁর গ্রাম মুধোলের প্রায় প্রতিটা পরিবারেই একজন দুজন দেবদাসী রয়েছেন। মঞ্জুলার মা, দিদিমাও দেবদাসী ছিলেন। কীভাবে কাটে তাঁদের জীবন? সমাজের সামনে সেই বাস্তব ছবিটাই তুলে ধরতে চান মঞ্জুলা।

মুধোল গ্রামের নিম্নবর্ণের মেয়েদের জীবনের পরিণতিই যে দেবদাসী হওয়া, একরকম তাই ধরে নিয়ে থাকেন সকলে। মঞ্জুলা কর্ণাটকের ব্যতিক্রমী কয়েকজন মহিলার একজন, যাঁরা সেই জীবন থেকে উঠে এসে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন, বলা ভালো আদায় করে নিতে পেরেছেন। ছোটো থেকে স্কুলের পাশাপাশি স্থানীয় যুবক যুবতীদের উদ্যোগে আয়োজিত একটি টিউশন ক্লাসে যেতেন মঞ্জুলা। পড়াশোনা তো হতই। সেইসঙ্গে সেখানে আলোচনা হত বিবেকানন্দের সমাজ দর্শন, ভারতের সংবিধান, মানুষের মৌলিক অধিকারের মতো বিষয়গুলিও। সেখান থেকে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন মঞ্জুলা। সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর অধিকার সকলেরই আছ, এই কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন।

এরই মধ্যে মঞ্জুলা যখন দশক শ্রেনির পরীক্ষা দিলেন, তার পরই গ্রামের ব্রাহ্মণ বর্ণের মানুষরা বাড়িতে আনাগোনা শুরু করলেন। মঞ্জুলার দিদিমাও একদিন জানালেন, যে তাঁকে এবার মন্দিরে যেতে হবে। হ্যাঁ, দেবদাসী হয়েই। কিন্তু মঞ্জুলা প্রতিবাদ করলেন। তিনি দেবদাসী হতে রাজি নন। দীর্ঘ বিতর্কের পর ঠিক হয়, পড়াশোনা করে যদি মায়ের দায়িত্ব মঞ্জুলা নিতে পারেন, তাহলে তাঁর দিদিমা সেই সুযোগ দিতে রাজি। দশক শ্রেনি পাশ করার পরেই তাই রোজগারের রাস্তা খুঁজলেন মঞ্জুলা।

প্রথমে একটি বেসরকারি হাসপাতালে রিসেপসনিস্ট হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। প্রতি মাসে মাইনে ছিল মাত্র ৫০০ টাকা। সেই টাকায় নিজের পড়াশোনা চালানোর পাশাপাশি সংসারের খরচও টানতে হত। পড়াশোনার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল বরাবরই। এমনকি খেলাধুলো বা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও যোগ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই সমস্ত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেলে বাবার নাম জানাতে হয়। অথচ দেবদাসী মায়ের সন্তানরা কেউই তাঁদের বাবার নাম জানেন না। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক এই সমস্ত বাধাকে পিছনে ফেলে ৩৫ বছর বয়সে। তিনি উড়ুপি ইউনিভার্সিটিতে সমাজবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করছেন।

আরও পড়ুন
রূপান্তরকামী প্রার্থী নিয়োগের সিদ্ধান্ত কর্ণাটক পুলিশের

আজ থেকে ৫০ বছর আগেও দেবদাসী প্রথা নিয়ে ভয়ঙ্কর দাঙ্গার সাক্ষী থেকেছে গোটা দক্ষিণ ভারত। সরকারি হিসাব অনুযায়ী এখন দেবদাসী প্রথা অবলুপ্ত। তবে বাস্তবটা তার থেকে বেশ কিছুটা আলাদা। বর্তমানের দেবদাসীদের নিয়ে উদাসীন সরকারও। বহু মানুষই জানেন না, কীভাবে তাঁদের দিন কাটে। অবসরপ্রাপ্ত দেবদাসীদের জন্য সরকারি পেনশনের ব্যবস্থা আছে। তবে সেই টাকাও ৩ মাস বা ৬ মাস পরপর হাতে এসে পৌঁছায় বলে অভিযোগ তুলেছেন মঞ্জুলা। এমনকি দেবদাসীদের সামাজিক উন্নতির জন্য যে সমস্ত স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করেন, তাঁদের স্টাইপেনও বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। মঞ্জুলা মনে করেন, একমাত্র শিক্ষার যথোপযুক্ত সুযোগই দেবদাসী প্রথার প্রকৃত অবসান ঘটাতে পারে। সমাজকে এবং সরকারকে এই বিষয়ে সচেতন করতে নিজের গবেষণার পরিসরকেই তাই বেছে নিয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন
দেশের দ্বিতীয় রূপান্তরকামী হিসাবে পদ্মশ্রী পেলেন কর্ণাটকের যোগাপ্পা নৃত্যশিল্পী

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
১০৮ বছরেও রোজ ‘সন্তান’দের দেখভাল, সাম্মানিক ডক্টরেট পেলেন কর্ণাটকের বৃক্ষ-জননী